দক্ষিণ এশিয়ায় জেন জি বিপ্লবের হাওয়ায় শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ-নেপালে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটছে? এখন অনেকের মনেই এমন প্রশ্ন জাগছে যে, দক্ষিণ এশিয়াই কী তাহলে জেন জি বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে? কলম্বো থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু, বিক্ষোভের উত্তাল হাওয়ায় স্বৈরাচারের পতন। প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন, কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার তরুণদের এই বিক্ষোভ প্রতিবাদের সঙ্গে একটি সাধারণ সূত্র জড়িত এবং প্রতিবাদকারীরা একে অপরের কাছ থেকেই শিখেছে।
ঢোলের তালের মতো লোহার গেটের ঝনঝন শব্দ ভেসে এলো। জনতা ধেঁয়ে এলো সামনে, ঝড়ের বেগে খুলে দিলো ব্যারিকেড-যা ঘণ্টাখানেক আগেও ক্ষমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শাসকদের বাড়ির করিডরগুলো কেঁপে উঠলো কাদামাখা পায়ের শব্দে। কেউ ভাঙলো জানালা, শোপিস, কেউ হাতে নিলো দামি বিছানার চাদর বা জুতা।
যে বাড়ি এতদিন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল, সেই প্রাসাদ আর বিলাসবহুল আসবাব এখন অস্থায়ীভাবে হলেও মানুষের দখলে। গত সপ্তাহে এমন ঘটনাই চোখে পড়েছে নেপালে। এর আগে ২০২২ সালে একই দৃশ্য দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায় এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশে।
তিন কোটি মানুষের দেশ নেপাল এখন এমন এক ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে, যা তাদের কাছে একেবারেই নতুন। দক্ষিণ এশিয়ার একের পর এক দেশে সরকার পতন হচ্ছে। মূলত তরুণদের ফুঁসে ওঠাই এর পেছনে বড় কারণ। এখন প্রশ্ন উঠছে দক্ষিণ এশিয়াই কী তাহলে জেন জি বিপ্লবের ঘাঁটিতে পরিণত হলো?
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, এটা সত্যিই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে এক ধরনের নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) প্রায় ১০ হাজার নেপালি তরুণ ভোট দিয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ডিসকোর্ডে। তারা নির্বাচনী ব্যালট বা শারীরিক ভোট নয়, ডিজিটাল ভোটের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ঠিক করেছে। এদের মধ্যে প্রবাসীরাও ছিল।
সামাজিক মাধ্যম বন্ধ রাখা এবং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বিরোধী বিক্ষোভে পুলিশের দমনপীড়নে ৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। টানা তিনদিন ধরে চলা বিক্ষোভে নেপাল সরকারের পতন হয়। এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সুশীলা কার্কি আগামী বছরের মার্চে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিক্ষোভের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি যখন বিক্ষোভকারীদের ‘জেন জির বাচ্চা” বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভ এতটাই উত্তাল হয়ে উঠেছিল যে তিনি পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
এসব ঘটনা এটাই দেখিয়ে দিয়েছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার তরুণরা যখন মনে করেন যে, রাজনৈতিক পদ্ধতি তাদের স্বপ্নের সঙ্গে বেমানান তখন তারা নিজেরাই ক্ষমতা হাতে নিচ্ছে এবং নিজেদের নেতা ঘোষণা করছে।
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের আন্দোলনের পেছনে ছিল নিজস্ব ইতিহাস ও আলাদা প্রেক্ষাপট। কিন্তু সবক্ষেত্রেই সাধারণ বিষয় হলো- নতুন এই প্রজন্ম ব্যর্থ প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাঁচতে নারাজ। মূলত এটাই তাদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে।
শ্রীলঙ্কা
২০২২ সালে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কা। দীর্ঘ সময় লোডশেডিং, ৫০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতি-এই অবস্থায় জন্ম নেয় ‘আরাগালায়া’ আন্দোলন। কলম্বোর প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে তরুণদের ক্যাম্প ‘গোটাগো গামা’ (গোটা বাড়ি ফিরে যাও) হয়ে ওঠে প্রতিবাদের কেন্দ্র। তীব্র প্রতিবাদ-আন্দোলনের মুখে সে বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ
২০২৪ সালে আন্দোলন শুরু হয় সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে। বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ১৪০০ মানুষ নিহত হলে আন্দোলন সরকারবিরোধী রূপ নেয়। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
নেপাল
গত সপ্তাহের শেষের দিকে সরকার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করলে রাস্তায় নামে হাজার হাজার মানুষ। পুলিশের গুলিতে ৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। আন্দোলনকারীরা সংসদে আগুন লাগায়, নেতাদের বাড়ি-ঘর ও সবচেয়ে বড় মিডিয়া হাউজও পুড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
তরুণদের ক্রোধের মূল কারণ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, এই তিন দেশে সরকার পতনের পেছনে মূল কারণ একই-অমীমাংসিত অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুর্নীতি এবং বয়স্ক রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বের প্রতি গভীর অসন্তোষ।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, জেন জি প্রজন্ম দুটি বড় অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছে (২০০৮-০৯ এবং কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে) এবং প্রায় দুই বছর সামাজিকভাবে তারা ছিল বিচ্ছিন্ন। করোনা মহামারী চলাকালীন সময়ে তাদের ডিজিটাল সংযোগ অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে।
এদিকে যেসব নেতাদের তারা উৎখাত করেছে তাদের মধ্যে নেপালের ওলির বয়স ছিল ৭৩ বছর, হাসিনার ৭৬ এবং রাজাপাকসের ৭৪ বছর। তরুণদের জীবনের সঙ্গে এসব রাজনীতিকের জীবনের ফারাক ছিল অনেক বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার তরুণরা এই রাজনীতিবিদের সঙ্গে নিজেদের কোনো কিছুরই মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এছাড়া রাজনীতিবিদ এবং তাদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনও তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
এভাবেই নেপোটিজম বা স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নতুন বিপ্লবের সূচনা হয়। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় নেপোকিড (#NepoKid) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ড হয়েছে এবং নেপালে সাম্প্রতিক গণআন্দোলনেও তরুণদের মধ্যে গভীর সাড়া ফেলেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ বিষয় হলো –তারা এক উন্নত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারে এবং বাস্তবতার সঙ্গে সেই আকাঙ্ক্ষার ব্যবধান দেখতে পায়।
আল জাজিরাকে স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, তাদের শক্তি হলো ভবিষ্যতপন্থি এই স্বপ্ন ও ক্ষোভ এবং পারস্পরিক সংযোগের অনুভূতি। এই দেশগুলোতে জনসংখ্যাগত অনেক মিল রয়েছে। তিন দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষই ২৮ বছরের নিচে। তাদের মাথাপিছু জিডিপি বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে কম হলেও সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আন্দোলনগুলো কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি বা একক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অভিযোগের ওপর নয় বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতার ওপর জোর দিয়েছে। ফলে এগুলো দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে আবেদনময় হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, যখন এসব সরকার বিক্ষোভের মুখে পড়ে, তাদের হাতে খুব বেশি বিকল্প থাকে না, বিশেষ করে অসম সমাজ বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হলে এমনটা ঘটে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক মাস্টার্স প্রোগ্রামের পরিচালক রুমেলা সেন বলেন, যদি আমরা কেবল ক্ষোভের ছবি দেখার বাইরে তাকাই, তাহলে দেখব – এসব প্রতিবাদে রয়েছে রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহির জন্য প্রকৃত গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা।
তরুণ জনগোষ্ঠী, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং ডিজিটাল দক্ষতা – এই তিনটি মিলেই দক্ষিণ এশিয়ার জেন জি তরুণদের এমনভাবে সংগঠিত করেছে যে তারা সহজেই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কমিউনিটি তৈরি, সংগঠন গড়ে তোলা এবং নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে।
সরকার যখন ইন্টারনেট বা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে, তা উল্টো ফল বয়ে আনে। নেপালে এই প্রজন্মের বিক্ষোভকারীরা নেপোকিডসদের বিলাসবহুল জীবনযাপন ও বিদেশে পড়াশোনা দেখেও চোখ ফিরিয়ে নিতে চায়নি। একদিকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে কিন্তু অন্যদিকে রাজনীতিবিদদের সন্তানরা বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছে এমনটা মেনে নিতে পারেনি জেন জি তরুণরা।
তিনি বলেন, এখানে এক ধরনের প্রজন্মগত নৈতিক ক্ষোভ আছে। যারা তাদের ভবিষ্যৎ চুরি করছে এমন এক প্রজন্মের বিরুদ্ধে তাদের চরম ক্ষোভ রয়েছে।
একে অপরের কাছ থেকে শিক্ষা
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানী জিভান শর্মা বর্তমানে কাঠমান্ডুতে গবেষণার জন্য অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, একে অপরের কাছ থেকে এবং ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো অন্যান্য যুব-নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক বিক্ষোভ থেকে শিক্ষা নিয়েই এসব আন্দোলনের জন্ম।
নেপালি তরুণরা শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের আন্দোলন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে বলে মনে করেন তিনি। এই জেন জি-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক আন্দোলন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি গভীর হতাশা থেকে জন্ম নিয়েছে।
স্ট্যানিল্যান্ডও এ বিষয়ে একমত। তিনিও মনে করেন যে, নিশ্চিতভাবেই এসব আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণরা একে অপরকে লক্ষ্য করছে, শিখছে এবং অনুপ্রাণিত হচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় গৃহযুদ্ধ ও বিদ্রোহী শাসন নিয়ে গবেষণা করা সেন বলেন, নেপাল ও অন্যান্য দেশের প্রতিবাদে ব্যবহৃত কৌশলগুলো- যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ প্রচারণা এবং বিকেন্দ্রীভূত সংগঠন এক নতুন ডিজিটাল প্রতিবাদের প্লেবুক তৈরি করেছে। এখন একটাই প্রশ্ন: পরবর্তী বিস্ফোরণ কোথায় ঘটবে?
সূত্র: আল জাজিরা
টিটিএন