চলতি ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তানদের জন্য ২ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছিল। তাতে দুই ধরনের শিক্ষা কোটায় আবেদন নেওয়া হয়, তা হলো- শিক্ষা কোটা-১ ও শিক্ষা কোটা-২।
শিক্ষা কোটা-১ এ আবেদনের সুযোগ পান শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত (সচিবালয়ের অভ্যন্তরে) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কিন্তু এতে অসংখ্য আবেদন জমা পড়ে। তার মধ্যে ২ হাজার ৪৪ জন কলেজে ভর্তির জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছেন।
তবে শিক্ষা কোটা-১ এ একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিতে এতসংখ্যক শিক্ষার্থী কোথা থেকে, কীভাবে এলো; তা নিয়ে ‘বিস্ময়’ প্রকাশ করেছেন খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তারা জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগে সব মিলিয়ে সাড়ে পাঁচশ থেকে ৬০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে এবার এসএসসি পাস করেছেন সর্বসাকুল্যে ১০০ জনের সন্তান। তাহলে একাদশে ভর্তিতে শিক্ষা কোটা-১ এ দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেলো কীভাবে?
কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছে ৪৮৭৭ জন
একাদশে ভর্তির কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্যমতে, এ বছর তিন ধাপে আবেদন নেওয়া হয়। এতে বিভিন্ন কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন ১০ লাখ ৬৬ হাজার ১৬৩ জন। তাদের মধ্যেই শিক্ষা কোটা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ৪ হাজার ৮৭৭ জন।
আরও পড়ুন
- অস্তিত্বহীন স্কুলের নামে নিবন্ধন করে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা
একাদশে ভর্তিতে শেষবার আবেদনের সুযোগ
মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নির্বাচিত হয়েছেন ১ হাজার ৫০৬ জন। অন্যদিকে, শিক্ষা কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৭১ জন। তাদের মধ্যে শিক্ষা কোটা-১ এ সুযোগ পেয়েছেন ২ হাজার ৭৭ জন এবং শিক্ষা কোটা-২ এ ১ হাজার ২৯৪ জন।
শিক্ষা কোটায় ব্যবসায়ী-বিমা কোম্পানির অভিভাবকের সন্তান
ভর্তি কমিটির সদস্যরা বলছেন, শিক্ষা কোটায় কারা আবেদন করতে পারবেন, কারা পারবেন না; তা আগেই বলা দেওয়া হয়েছে। তারপরও ব্যবসায়ী, বিমা কোম্পানিতে চাকরি করেন এমন অভিভাবকের সন্তানও এ কোটায় আবেদন করেছে।
একাদশে ভর্তি কমিটির সমন্বয়কারী ও ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক রিজাউল হক জাগো নিউজকে বলেন, অনলাইনে আবেদন করায় কোটা প্রযোজ্য নয়- এমন অসংখ্য শিক্ষার্থী আবেদন করেছে। তাদের উদ্দেশ্য অসৎ। কিন্তু তারা নির্বাচিত হয়ে গেলেও চূড়ান্ত ভর্তির সুযোগ পাবে না। কারণ কলেজে সশরীরে চূড়ান্ত ভর্তি হতে গেলে প্রত্যয়নপত্র দেখাতে হবে। সেটা দেখাতে না পারলে বাদ পড়ে যাবে তারা।
তবে অভিভাবকরা বলছেন, অনেক শিক্ষার্থী ভুয়া প্রত্যয়নপত্র বানিয়ে এনে কলেজে জমা দিচ্ছে। কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা ভর্তিও হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মোটা অংকের অর্থ লেনদেন হচ্ছে।
শিক্ষা কোটা-১ ও শিক্ষা কোটা-২ যাদের জন্য প্রযোজ্য
শিক্ষা কোটা-১ পাওয়ার কথা ছিল শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সরাসরি কর্মরত সচিব, অতিরিক্ত সচিব, উপ-সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, সহকারী সচিব ও অন্যান্য বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
শিক্ষা কোটা-২: ইউজিসি, বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল, মাউশি অধিদপ্তর, এনটিআরসিএ, ব্যানবেইস, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট, এনসিটিবি, নায়েম, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেস্কো কমিশন (বিএনসিইউ), ১১টি শিক্ষা বোর্ড, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নেকটার)।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়েও নানা ‘প্রশ্ন’
চলতি বছর বীর মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন এক হাজার ৫০৬ জন। এ কোটায়ও এতসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকার কথা নয় বলে মনে করেন খোদ ভর্তি কমিটির সদস্যরা।
তারা বলছেন, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সর্বনিম্ন বয়স ১২ বছর ৬ মাস। সেই হিসাবে ২০২৫ সালে এসে ১৯৭১ সালের সবচেয়ে কম বয়সী মুক্তিযোদ্ধার বয়সও এখন ৬৭ বছর। এ বয়সী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও কম।
অথচ তাদের দেড় হাজারের বেশি সন্তান এবার মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, যাদের বয়স এখন ১৬-১৭ বছর। এ নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ে পড়েছেন খোদ শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। স্পষ্টত অনিয়ম হয়েছে জেনেও তারা নিশ্চুপ।
ঢাকা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা, যিনি এবার একাদশে ভর্তির কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ বছরের নীতিমালায় মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোটা বন্ধে সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় এটি বহাল রেখেছে। যার ফলে ভর্তি কার্যক্রমে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেহেতু এখন মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কোটা নেই, সে কারণে এসব কোটার যৌক্তিকতাও এখন নেই।
কোটা না রাখার পক্ষে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলুও। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কোটা নিয়ে ঐতিহাসিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পর আর কোনো কোটাব্যবস্থা রাখায় উচিত না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সম্মান প্রদর্শনের জন্য রাখতে পারে। কিন্তু সেটাও সীমিত করা উচিত। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চাকরি করলেই তার সন্তান পছন্দের কলেজের পড়বেন? এটা কোনো নিয়মে পড়ে না। এখন সব কোটা বাতিল করাটাই সময়পোযোগী সিদ্ধান্ত হবে।
ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক এবং একাদশে ভর্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অধ্যাপক রিজাউল হক বলেন, কোটার অনিয়মের কারণে এবার অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তার পছন্দের কলেজে ভর্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমাদের জায়গা থেকে যেটুকু করার সেটা আমরা করেছি। এখন এটা বন্ধে অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহেনা পারভীন জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে খোঁজ-খবর নেবো। কীভাবে অনিয়ম হয়েছে বা কেউ অনিয়ম করে ভর্তি হতে সক্ষম হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
এএএইচ/এএমএ