টানা কয়েক মাস ধরে বৃষ্টিহীন দেশের দক্ষিণাঞ্চল। সারা দেশের অবস্থাও প্রায় একই। নভেম্বরের পরে সে অর্থে বৃষ্টিপাত হয়নি। আবহাওয়ার এমন বিরূপ আচরণে হুমকির মুখে রবিশস্যের উৎপাদন। বৃষ্টির দেখা না পাওয়ায় রবিশস্যের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, দিগন্ত জোড়া ক্ষেতে এখন মুগ, ভুট্টা, কাঁচা মরিচ, বাদামসহ বিভিন্ন রবিশস্য। তবে গাছে ফলন আসছে কম। যতটুকু ফলন আসছে তা আবার শুকিয়ে যাচ্ছে খরতাপে।
কৃষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় শস্যক্ষেত একেবারেই শুষ্ক হয়ে গেছে। এতে শস্যের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মুগ ডালের গাছ হলেও তাতে শুঁটি (যেটায় দানা ধরে) ধরছে না। পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। শুঁটি ধরলেও হচ্ছে না পুষ্ট। গরমের কারণে অপুষ্ট মরিচ শুকিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনোটা পাকার আগেই লাল হয়ে ঝরে যাচ্ছে।
পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলায় মাছুয়াখালী গ্রামের কৃষক মো. বেলাল মৃধা বলেন, ‘এবার মুগ চাষ করে আমরা মনে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। গাছ সুন্দর দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কোনো ফল আসেনি। দু-একটি কাছে দানার ছড়া (শুঁটি) এলেও তা অপুষ্ট। অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’
বৃষ্টিহীন এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমরা ফলনের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছি সেটি প্রত্যাশার তুলনায় কম হতে পারে। মুগের জন্য বৃষ্টিটা দরকার ছিল আরও একমাস আগে। সেটা হয়নি। পুরো মার্চ মাস পটুয়াখালী জেলা বৃষ্টিহীন ছিল।- কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পটুয়াখালী কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম
একই গ্রামের আরেক কৃষক বাবুল শিকদার বলেন, ‘বৃষ্টি না হওয়ায় আমার অপুষ্ট মরিচ গাছগুলো ক্ষেতে শুকিয়ে যাচ্ছে। মুগের অবস্থাও বেশি ভালো না। কিছুদিনের মধ্যে বৃষ্টি না হলে আমাদের এখানে এবার ফলন খুব খারাপ হবে। মরিচ ও ডালের বাজার অনেক চড়া থাকবে।’
- আরও পড়ুন
- ফলন কম/মানিকগঞ্জে খেসারি কালাই ঘরে তুলতে ব্যস্ত কৃষক
- এক ফোঁটা পানি, এক ফোঁটা জীবন
- আমনের ক্ষতি কাটাতে বোরো উৎপাদনে করণীয়
কৃষি অফিস সূত্র জানায়, পটুয়াখালী জেলায় এবার এক লাখ ২০ হাজার টন মুগডাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পটুয়াখালী কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বৃষ্টি না হওয়ার কারণে মুগ ডালের ফলনে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভালো হতো। ভুট্টার ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে, বৃষ্টি হলে ভুট্টার ফলনও ভালো হতো।'
তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিহীন এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আমরা ফলনের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছি সেটি প্রত্যাশার তুলনায় কম হতে পারে। মুগের জন্য বৃষ্টিটা দরকার ছিল আরও একমাস আগে। সেটা হয়নি। পুরো মার্চ মাস পটুয়াখালী জেলা বৃষ্টিহীন ছিল।’
উপ-পরিচালক বলেন, ‘বৃষ্টি না হওয়ার কারণে পটুয়াখালীতে ভুট্টা ও আমনের বীজতলার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। বৃষ্টি না হলে আউশ ধানের বীজতলাটা কৃষক করতে পারবে না। বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে তারা বীজতলা তৈরি করেন।’
পটুয়াখালী জেলায় চলতি মৌসুমে ৮৮ হাজার হেক্টরে জমিতে মুগ চাষ হয়েছে জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ২০ হাজার টন। তবে আবহাওয়া এ রকম থাকলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। জেলায় ভুট্টা আবাদ করা হয়েছে আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে। হেক্টরপ্রতি ১০ টন হিসেবে ২৫ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আউশ আবাদ হবে ১৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে চার টন হিসেবে আউশে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে মোট ৬২ হাজার টন।’
অস্বাভাবিক আবহাওয়া
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো দক্ষিণাঞ্চলেও এখন অস্বাভাবিক আবহাওয়া বিরাজ করছে। দিনে প্রচণ্ড গরম অনুভূত হচ্ছে। সন্ধ্যার পরেই পাল্টে যাচ্ছে আবহাওয়া। সন্ধ্যার পর ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে তাপমাত্রা। গভীর রাতে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে।
এমনকি গভীর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কুয়াশাও পড়ছে কোথাও কোথাও। এ সময়ে দক্ষিণ দিক থেকে যে বাতাসটা আসে সেটিও নেই। তাই দিনে প্রচণ্ড গরম লাগছে। শেষ চৈত্রের এই আবহাওয়ায় অনেকেই অবাক হচ্ছেন।
আমরা একটা পরিবর্তনশীল অবস্থানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। শীত বিদায় নিয়ে গরম এসেছে। এখন দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস বয়ে যাওয়ার কথা। একই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় পটুয়াখালীতে রাতের তাপমাত্রা কমে গেলে রাতে কুয়াশার মতো সৃষ্টি হচ্ছে। রাতের তাপমাত্রাটা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকছে।- আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির
পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার বড় গোপালদী গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ মো. আমজেদ মৃধা বলেন, ‘এ রকম আবহাওয়া তো জীবনে দেখিনি। এই সময়ে রাতে গরমে ঘর রেখে বাইরে ঘুমানো লাগতো। এখন রাতে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাই। কোন যুগ আসলো বুঝলাম না।’
আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা একটা পরিবর্তনশীল অবস্থানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। শীত বিদায় নিয়ে গরম এসেছে। এখন দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস বয়ে যাওয়ার কথা। একই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় পটুয়াখালীতে রাতের তাপমাত্রা কমে গেলে রাতে কুয়াশার মতো সৃষ্টি হচ্ছে। রাতের তাপমাত্রাটা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকছে।’
এ আবহাওয়াবিদ আরও বলেন, ‘পটুয়াখালীর আবহাওয়া ধীরে ধীরে কমবে। ১০ এপ্রিলের পর পটুয়াখালীসহ সারাদেশে বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার পটুয়াখালীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৪ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গত মার্চ মাসে সারাদেশেই স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আরএমএম/এএসএ/এএসএম