দহনকাল: কালের সিঁড়ি বেয়ে

1 month ago 11

ইব্রাহিম খলিল

বেশ কিছুদিন আগে হাতে পেয়েছিলাম কবি ইয়াসিন আযীযের কাব্যগ্রন্থ ‘দহনকাল’। দেশের সংকটময় মুহূর্তের কারণে বইটি পড়া হয়ে ওঠেনি। মূলত দুই মাস আগে কবি মেহেদী মিজান সম্পাদিত সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘কীর্তিনাশার কাব্য’র লেখক কপি সংগ্রহের জন্য শরীয়তপুর সদরে গিয়েছিলাম। কবি ইয়াসিন আযীযের আমন্ত্রণে। কীর্তিনাশা কাব্যের তিনি নির্বাহী সম্পাদক। সেখান থেকেই তার লেখা কাব্যগ্রন্থ দহনকাল পেয়েছি।

প্রচ্ছদশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগরের করা নান্দনিক প্রচ্ছদ দেখেই বইটি পড়ার প্রবল আগ্রহ যেন আরও বেড়ে যায়। নানা জটিলতা কাটিয়ে কিছুদিন আগেই বইটিতে চোখ রাখার সুযোগ পাই। কবি ইয়াসিন আযীযের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে এর আগেও আমি পরিচিত ছিলাম। ফেসবুকে যুক্ত থাকায় তার লেখা বেশকিছু কবিতা আমার পড়ার সুযোগ হয়েছিল।

কবি ইয়াসিন আযীয আমাদের শরীয়তপুরের কীর্তিনাশা নদীর ওপরে অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। তাছাড়া শরীয়তপুরের অনেক কীর্তিমান লেখককে তিনি তুলে এনেছেন আমাদের মাঝে তার চমৎকার চমৎকার প্রবন্ধের মাধ্যমে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তার অবাধ বিচরণ থাকলেও কবিতায় যেন তিনি অনন্য অসাধারণ এক প্রতিভা। তার ‘দহনকাল’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে আমার কাছে অন্তত তা-ই মনে হয়েছে।

কবিতার বই বলতেই মানুষ প্রেম-ভালোবাসা মিশ্রিত এক আবেগের বহিঃপ্রকাশ ভেবে থাকেন। সেই প্রচলিত ভাবধারাকে ভেঙে দিয়ে কবি ইয়াসিন আযীয তার কাব্যগ্রন্থটি সাজিয়েছেন ভিন্নভাবে ভিন্নমাত্রায়। কবির বিপ্লবী হাত ধরে এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা এসেছে কালের সিঁড়ি বেয়ে। অর্থাৎ সময়ের নানা ঘটনার মধ্যদিয়ে। বিশ্ব মহামারি করোনাকাল থেকে শুরু করে সময়ে-অসময়ে আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া নানা সংকটের কথা নিয়ে। এই কাব্যগ্রন্থে লিপিবদ্ধ কবিতাগুলো পড়লেই কাব্যগ্রন্থের না্মকরণের সার্থকতা খুব সহজেই খুঁজে পাবেন প্রতিটি পাঠক।

তার রচিত কবিতাগুলো অবলীলায় বলে যায় মনুষ্যত্ব এবং বোধের কথা। যেমন-
‘কড়াপড়া হাতে সন্তানের মুখে পুরি এক টুকরো রুটি
এইটুকুই সুখ, এইটুকুই সন্তুষ্টি
তবুও বিনাদোষে গালি দাও, করো প্রবঞ্চনা।
দাস অথবা ক্রীতদাস থেকে শ্রমিক হলাম
আফসোস, মানুষ হলাম না।’
(মানুষ হলাম না)

কখনো কবি তার নিজ জেলার বন্যা পরিস্থিতি তুলে এনেছেন তার কাব্যের নান্দনিক দোলায়। শরীয়তপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত কবিতাটি প্রমাণ করে তার নিজ জেলার প্রতি গভীর মমত্ববোধ। যেমন-
‘আইতে আইতে পদ্মা নদী ভাইঙ্গা নিলো বাড়িঘর
মাতা গোঁজার ঠাঁইও গেলো নদীর পেটে একের পর...।
গেলো বছর জমি-জিরাত ভাইঙ্গা আছিলো বারো-আত দূরে/
এই বছর আবোর নতুন কইরা ভাঙ্গন ধরছে শইরাতপুরে।’
(রাক্ষুসী পদ্মা)

সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে লিখতে লিখতে কবির কলম কখনো হয়ে উঠেছে প্রচণ্ড আশাবাদী। সমস্ত প্রতিকূলতার অবসাদ কাটিয়ে কবি গাইতে চেয়েছেন শিকল ভাঙার গান। ভেঙেচুরে সমাজকে নিজ হাতে গড়ে তোলার এক অবাধ আহ্বানও করেছেন কবিতায়। যেমন-
‘আমাদের হাতেই বদলাতে হবে সব জরাজীর্ণতা
দেবদূত আসবে না-সত্যের আমল নেই।
আমাদেরই ভাবতে হবে জীর্ণ সমাজের-
ঘুণে ধরা সময়ের কথা;
লিখতে হবে সুকান্তের বাকি কথন।
এই তরি বাইতে হবে, বিদ্রোহী হয়ে গাইতে হবে
প্রেমহীন-দহনকালের গান।
(দহকালের গান)

বলতে গেলে এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই একেকটি সময়ের বুলেট, যা কবির কলমের ডগা বেয়ে আশ্রয় নিয়েছে দহনকালে। এযাবতকালে আমার পড়া কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কবিতার বইটি সত্যি অনন্য। পড়ে অসাধারণ লেগেছে। কবি ইয়াসিন আযীয বয়সে তরুণ হলেও তার লেখা প্রতিটি কবিতাই পরিপক্ব ও দক্ষ হাতের সৃজন বলেই মনে হয়। আমি চমৎকার কাব্যগ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

কাব্যগ্রন্থ: দহনকাল
কবি: ইয়াসিন আযীয
প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর
প্রকাশনী: অনন্যা
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
মূল্য: ২৫০ টাকা।

এসইউ/জিকেএস

Read Entire Article