দুই টাকার হোটেলে তৃপ্তির খাওয়া, মেন্যুতে থাকে গরুর মাংস-মাছ-ডাল

2 weeks ago 10

সাজানো-গোছানো চেয়ার-টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন শিশুসহ একদল নারী-পুরুষ। মেহমানদারি করছেন কিছু তরুণ ও যুবক। দেখে মনে হবে কোনো অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়া চলছে। তবে এটি কোনো অনুষ্ঠানের আপ্যায়ন নয়, যারা খাচ্ছেন তারা অসহায় ও শ্রমজীবী মানুষ। দুই টাকা হোটেলে তাদের খাওয়াচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

সপ্তাহের দুদিন এই হোটেলে নামমাত্র দুই টাকা দিয়ে অসহায় ও শ্রমজীবী মানুষ দুপুরে পেট ভরে খেতে পারেন। বাড়িতে রান্না করা সাদা ভাত ও ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে থাকে খাসি, গরু ও মুরগির মাংস। আরও থাকে ইলিশ, মুড়িঘণ্ট ও ডাল। খাওয়া শেষে কোনো কোনো দিন থাকে মিষ্টি ও পান-সুপারির ব্যবস্থা। প্রতিদিন বিশেষ এই হোটেলে ৬০-৭০ জন শ্রমজীবীরা খেতে পারছেন।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে মাছ-মাংস খাওয়া অসহায় শ্রমজী‌বী মানুষের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। এদের কথা চিন্তা করে রাজবাড়ীতে দুই টাকার হোটেলটি গড়ে তুলেছেন মাহিন শিকদার, ম‌নিরুল হক আকাশ, রাব্বি শেখসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী।

দুই টাকার হোটেলে তৃপ্তির খাওয়া, মেন্যুতে থাকে গরুর মাংস-মাছ-ডাল

হোটেলটি রাজবাড়ী শহরের রেলস্টেশন সংলগ্ন ফুলতলা এলাকায় অবস্থিত। স্টেশন সংলগ্ন হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের সন্ধানে আসা শ্রমজীবী, রিকশাচালক ও অসহায় মানুষ দুপুরে এখানে খেতে পারছেন।

সরেজ‌মি‌ন দেখা যায়, একদল তরুণ-যুবক রাজবাড়ী রেলস্টেশন সংলগ্ন ফুলতলায় রাস্তার একপাশে চেয়ার-‌টে‌বিল সা‌জিয়ে রেখেছেন। টে‌বিলে রয়েছে পা‌নির জার, ওয়ান টাইম প্লেট ও গ্লাস। পাশেই এক‌টি ভ্যানের ওপর বড় বড় গামলা ও পা‌তিলে রাখা রয়েছে বাড়ি থে‌কে রান্না করে আনা চিকন চালের ভাত, গরু-মুর‌গির মাংস ও ডাল। রাস্তার পাশে রিকশা রেখে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছেন শ্রমজীবীরা। টেবিলগুলো মানুষে পূর্ণ হলেই পরিবেশন করা হচ্ছে খাবার।

দুই টাকার হোটেলে তৃপ্তির খাওয়া, মেন্যুতে থাকে গরুর মাংস-মাছ-ডাল

খেতে এসেছেন আমিন মিয়া। তিনি পেশায় একজন রিকশাচালক। আমিন মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘দুই টাকার হোটেলে গরুর মাংস ও ডাল দিয়ে ‌পেট ভরে ভাত খেয়েছি। শুধু আমি না, আমার মতো ৬০-৭০ জন খেয়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে গরুর মাংসের যে দাম, আমরা বছরে দুই একবারও খেতে পারি না। কিন্তু আজ তৃপ্তি সহকারে খেয়েছি। আমার খুব ভালো লেগেছে। দোয়া করি ওনারা যেন এভাবে আমাদের পাশে থাকেন।’

আরেক রিকশাচালক শাহজাহান শেখ বলেন, ‘দুই টাকায় ভালো একটা চকলেটও হয় না। আজ দুুই টাকায় গরুর মাংস, ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছি। খাবারও অনেক সুস্বাদু হয়েছে। এর আগে এখানে ভুনা ইলিশ-‌খিচুড়ি, খা‌সি‌র মাংস, মিষ্টি খেয়েছি।’

দুই টাকার হোটেলে তৃপ্তির খাওয়া, মেন্যুতে থাকে গরুর মাংস-মাছ-ডাল

দিনমজুর আলী হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি গ‌রিব মানুষ। কাজের সন্ধানে রাজশাহী থে‌কে রাজবাড়ীতে এসে‌ছি। সারাদিন কোনো কা‌জ না পেয়ে স্টেশ‌নে বসে ছিলাম। তখন শুনতে পাই স্টেশনের পাশে দুই টাকায় দুপুরে মাছ-মাংস-ভাত পাওয়া যায়। পরে এখানে এসে গরুর মাংস দি‌য়ে পেট ভরে ভাত খেয়েছি।’

উদ্যোক্তাদের একজন শিক্ষার্থী মা‌হিন শিকদার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেক মানুষ আছে, যারা ভালো-মন্দ খাওয়া তো দূরের কথা; অনেক সময় না খেয়ে তাদের দিন কাটে। ওইসব মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে, তাদের ভালোবেসে আমাদের এই উদ্যোগ।’

শুরুর দিকের গল্প শুনিয়ে মাহিন শিকদার বলেন, ‘হোটেল শুরু করতে আমরা রান্না করা নিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়ি। এসময় সাগর ভাইয়ের আম্মু আমাদের দুই টাকার হোটেলের কথা শুনে সব‌কিছু রান্না করে দিতে রাজি হন। এরপর থেকে আমরা বাজার করে এনে দিলে আন্টি নি‌জ হাতে সব খাবার রান্না করে দেন।’

দুই টাকার হোটেলে তৃপ্তির খাওয়া, মেন্যুতে থাকে গরুর মাংস-মাছ-ডাল

ম‌নিরুল হক সাগর নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের হোটেলের নাম ‘দুই টাকার হোটেল’ দেওয়ার কারণ আমাদের রাজবাড়ী শহরে দুই টাকার নোট কোনো ব্যবসায়ী বা কেউ নিতে চায় না। এজন্য চিন্তা করে আমরা হোটেলের নাম দিয়েছি ‘দুই টাকার হোটেল’। যাতে ক‌রে দুই টাকা দিয়ে শ্রমজীবীরা আমাদের হোটেলে এসে একবেলা ভালো খেতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে নিম্নমানের কোনো খাবার দেওয়া হয় না, সম্পূর্ণ বাসায় রান্না করা এবং আমরা যা খাই সেটা এখানে দেওয়া হয়। সপ্তাহে দুদিন আমরা হোটলের কার্যক্রম চালাই এবং আমরা নিজেরাই মেহমানদারিত্ব করি।’

দুই টাকার হোটেলে তৃপ্তির খাওয়া, মেন্যুতে থাকে গরুর মাংস-মাছ-ডাল

উদ্যোক্তা রা‌ব্বি শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘নামমাত্র দুই টাকার হোটেল। মূলত অসহায় ও শ্রমজীবী মানুষদের সম্মান জানাতে দুই টাকার হোটেল নামকরণ করা হয়েছে। অনেকের কাছ থেকে আমরা টাকাই নিই না। আমাদের ইচ্ছা আছে এই কার্যক্রম দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়ার।’

স্থানীয় সা‌হিদা আক্তার প‌পি বলেন, ‘দুই টাকার হোটেলের মূল উদ্যোক্তা মা‌হিন। ও নিজেই অসুস্থ। তারপরও বন্ধু-বড় ভাইদের নিয়ে এ উদ্যোগ নি‌য়েছে। এটা স‌ত্যিই প্রশংশনীয়।’

এসআর/জেআইএম

Read Entire Article