দুধের ভেজালে জীবন সংকটে

14 hours ago 4

• সিন্ডিকেটের থাবায় উত্তরের জেলা সিরাজগঞ্জ ও পাবনার গ্রামাঞ্চল
• সোডা, স্কিমড মিল্ক, ডিটারজেন্ট এবং পামওয়েলের ভয়ঙ্কর মিশ্রণ

পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা ইউনিয়নের গ্রাম চকচকিয়া। দিনের আলোতে বড়াল নদীর পাশের ছিমছাম পরিবেশ। রাতে দেখা মেলে ভয়ঙ্কর চিত্রের। ক্রেতা সেজে সন্ধ্যার কিছু পরে গ্রামে ঢুকতেই নাকে এলো কেমিক্যালের ঝাঁঝালো গন্ধ। সঙ্গী স্থানীয় একজন মুচকি হেসে বললেন, এই গন্ধ মানেই কারখানা চলছে। প্রায় আধা কিলোমিটার হাঁটাপথ পেরিয়ে গোডাউন আকৃতির একটি টিনশেড ঘরে ঢুকেই চক্ষু চড়কগাছ। মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কস্টিক সোডার প্যাকেট, স্কিমড মিল্ক পাউডার, চিনির বস্তা। আরেকপ্রান্তে ডিটারজেন্ট প্যাকেট ও পামওয়েলের ড্রাম। কয়েকজন শ্রমিক ব্যস্ততার সঙ্গে এগুলো পরিমাণমতো নিয়ে পানি মিশিয়ে বানাচ্ছেন দুধের মতো এক ধরনের সাদা তরল। এটিই নাকি আসল দুধ। কাজ শেষে তরলগুলো ড্রাম থেকে প্লাস্টিকের বড় ক্যান ও সিলভারের বোতলে ভরা হচ্ছে। এক কোণায় রাখা আছে ক্রেতার অর্ডারের তালিকা। তাদের তৈরি এই পণ্যগুলো ভোরের আলো ফোটার আগেই ট্রাকে করে চলে যাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

সরেজমিন ঘুরে নিজ চোখে দেখার পরও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে ক্রেতা সেজে কথা বলে মিলেছে আরও রোমহর্ষক তথ্য। চকচকিয়ার মতো এই ইউনিয়নের আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রতিরাতেই এই সাদা দুধ ব্যবসার আড়ালে চলে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।

একইভাবে খাঁটি ঘিয়ের সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় নকল ঘি। প্রায় ১৫ কেজি সয়াবিন তেল ও ভেজিটেবল ফ্যাটের সঙ্গে পাঁচ কেজি খাঁটি ঘি, এক কেজি আলুর পেস্ট, রঙ ভালোভাবে মিশিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়। এটি দানাদার হওয়ায় ভেজাল বোঝার কোনো উপায় থাকে না। নকল এই মিশ্রণটি খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে বাজারজাত করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতি কেজি ভেজাল ঘি তৈরিতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে।

কারখানার একজন শ্রমিক জানালেন, প্রতিদিন শুধু তাদের কারখানা থেকে ৩০০-৫০০ লিটার ভেজাল দুধ চলে যায় দেশের বিভিন্ন মিষ্টির দোকান ও প্যাকেটজাত দুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানির কাছে। সেই হিসেবে শুধু এই ইউনিয়নেই কয়েক হাজার লিটার নকল দুধের কারবার চলে।

যেভাবে দুধ নকল হয়

নকল দুধ তৈরি করার প্রক্রিয়াটি সামনা-সামনি দেখাতে রাজি হননি কোনো ব্যবসায়ী কিংবা ঘোষ (গোয়ালা সম্প্রদায়ের পদবি)। তবে এই কাজ করেন এমন একজন শ্রমিক জানান, খামারিরা তাদের কাছে এক মণ আসল দুধ বিক্রি করেন ২১০০ থেকে ২২০০ টাকায়। প্রথমে এই দুধ থেকে মেশিনের সাহায্যে সাড়ে তিন কেজি ননি (ক্রিম) বের করা হয়। প্রতি কেজি ২৬৫/২৭০ টাকা হিসেবে ননিগুলো বিক্রি হয় ৯৩০ থেকে ৯৫০ টাকায়। ননি বের করার পর ননির ঘাটতি মেটাতে দেড়কেজি পামওয়েল তেল মেশানো হয়। সেটি বড়বড় ব্লেন্ডার মেশিনে ব্লেন্ড করলে সেই একই দুধে কৃত্রিম ননি তৈরি হয়। অর্থাৎ তেলের দাম ২৫৮ টাকা বাদ দিলে শুরুতেই প্রতিমণে লাভ হয় ৬৯২ থেকে ৭০০ টাকা!

আরও তথ্য জানতে ক্রেতা সেজে ঘোরাঘুরি করাকালে জানা গেলো দুধ থেকে ননি আলাদা করার পর সেটি বড় আকারের চৌকোনা কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। এটি থেকে তৈরি হয় ছানা। তৈরি হয়ে গেলে সেটি ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তোলা হয়। কাড়াইয়ে থাকা দুধের ঘোলা পানিই তখন নকল দুধ তৈরির প্রধান উপকরণ। প্রতিমণ ছানার পানিতে ১ কেজি ননি, সামান্য পরিমাণ লবণ, খাবার সোডা, ১ কেজি চিনি, পরিমাণ মতো কস্টিক সোডা, স্কিমড মিল্ক পাউডার ও পামওয়েল তেল মিশিয়ে ব্লেন্ড করে অবিকল দুধ তৈরি হয়ে যায়। কাজ শেষ হলে এটি রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া আসল না নকল বোঝার উপায় থাকে না। শেষে দুধকে তাজা দেখাতে মেশানো হয় ফরমালিন। দুধের ঘনত্ব নির্ণয়ে ল্যাকটোমিটার ব্যবহার করে ভেজাল শনাক্ত করা যায় বলে ফরমালিনসহ স্কিমড মিল্ক পাউডার ব্যবহার করা হয়। এতে ঘনত্ব বেড়ে যায় এবং দুধ দীর্ঘক্ষণ তাজা থাকে। যার কারণে ল্যাকটোমিটার দিয়েও এই প্রতারণা সহজে ধরা সম্ভব হয় না। ডেমরার গ্রামগুলোতে ভেজাল দুধ তৈরির কাজ চলে প্রায় প্রতিদিনই ভোর থেকে সকাল আটটা-নয়টা এবং সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। খুব সকালে ট্রাক, লড়ি, পিকআপ, অটোভ্যানে করে এসব দুধ চলে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

ভেজাল ঘি ও দুধের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। এতে ব্যবহৃত কেমিক্যাল যেমন সোডা, ডিটারজেন্ট এবং সয়াবিন তেল শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এসব উপাদান হজম প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটায়, লিভার ও কিডনির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পাশাপাশি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং পেটের আলসারের মতো জটিল রোগ দেখা দিতে পারে।

অনুসন্ধানকালে আরও জানা যায়, পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, সুজানগর, আটঘড়িয়া এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি ও কাজীপুর উপজেলার ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার ২০০ কেজি (২৮০ মণ) ছানা তৈরি করেন। ওই পরিমাণ ছানা তৈরিতে এক হাজার ৪০০ মণ দুধের প্রয়োজন হয়। ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা ছানা তৈরির পর ছানার পানি ফেলে না দিয়ে তা বড় বড় ড্রামে সংরক্ষণ করেন। পরে এই পানিই নকল দুধে পরিণত হয়। প্রতিটি কারখানায় সব সময় দুই থেকে পাঁচ হাজার লিটার ছানার পানি মজুত রাখা হয়।

একইভাবে খাঁটি ঘিয়ের সঙ্গে নানা উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় নকল ঘি। প্রায় ১৫ কেজি সয়াবিন তেল ও ভেজিটেবল ফ্যাটের সঙ্গে পাঁচ কেজি খাঁটি ঘি, এক কেজি আলুর পেস্ট, রঙ ভালোভাবে মিশিয়ে ভেজাল ঘি তৈরি করা হয়। এটি দানাদার হওয়ায় ভেজাল বোঝার কোনো উপায় থাকে না। নকল এই মিশ্রণটি খাঁটি গাওয়া ঘি হিসেবে বাজারজাত করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতি কেজি ভেজাল ঘি তৈরিতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা দরে।

গো-খাদ্যের তুলনায় দুধের দাম বাড়েনি। দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো ৪ দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ফ্যাটের (ননি যুক্ত) দুধ প্রতি লিটার ৫২-৫৭ টাকা দরে কিনছে। এই মানের দুধ খুব কম উৎপন্ন হয়। খোলা বাজারে প্রতিলিটার দুধ ৬৫-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খোলা বাজারে দুধের চাহিদা বেশি থাকায় এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ কম থাকার সুবিধা নিচ্ছে অসাধু এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। এরাই নকল দুধ ও ঘি বাজারজাত করে এই শিল্পের বারোটা বাজাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনার ফরিদপুর ছাড়াও বেড়া, সাঁথিয়া, ভাঙ্গুড়া ও সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। দিনে প্রায় ৪ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয় সেখানে। এখান থেকে সরকারি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটাসহ বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করে থাকে।

দুধ সংগ্রহের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে স্থাপন করেছে প্রচুর শীতলীকরণ ও সংগ্রহ কেন্দ্র। দীর্ঘসময় ভালো রাখার জন্য দুধ এসব শীতলীকরণ কেন্দ্রে রাখা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ভেজালকারীরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কিছু শীতলীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের হাত করে মোটা টাকা লেনদেনের মাধ্যমে সেখানে ভেজাল দুধ সরবরাহ করে।

ভেজাল দুধ বানাচ্ছেন শ্রমিকরা-ছবি জাগো নিউজভেজাল দুধ বানাচ্ছেন শ্রমিকরা-ছবি জাগো নিউজ

ফরিদপুর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা কায়সার মো. রুহুল আমিন জানান, সেখানে ১২৭টি নিবন্ধিত দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির বেশির ভাগ বাঘাবাড়ি মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহ করে। এছাড়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আরও ব্যক্তিগত দুই সহস্রাধিক দুগ্ধ উৎপাদনের খামার রয়েছে। শুধু এই বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫৪টি দুধ সংগ্রহ পয়েন্ট রয়েছে। উৎপাদিত দুধের প্রায় ৭০ শতাংশ এসব প্রতিষ্ঠান নেয়। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ দুধ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকেন।

পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, সুজানগর, আটঘড়িয়া এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচি ও কাজীপুর উপজেলার ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার ২০০ কেজি (২৮০ মণ) ছানা তৈরি করেন। ওই পরিমাণ ছানা তৈরিতে এক হাজার ৪০০ মণ দুধের প্রয়োজন হয়। ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা ছানা তৈরির পর ছানার পানি ফেলে না দিয়ে তা বড় বড় ড্রামে সংরক্ষণ করেন। পরে এই পানিই নকল দুধে পরিণত হয়। প্রতিটি কারখানায় সব সময় দুই থেকে পাঁচ হাজার লিটার ছানার পানি মজুত রাখা হয়।

ডেমরা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব এক প্রবীণ বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একটি চক্র গরুর দুধের বদলে এখন এই কেমিক্যালের দুধ বানিয়ে পুরো গ্রামের সুনাম নষ্ট করে দিচ্ছে। আগে মানুষ এখানকার খাঁটি দুধের সুনাম করতো। আর এখন শুধু ভেজালের জন্যই নামডাক। তিনি স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। বলেন পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট মাঝে মাঝে আসে। জরিমানা করে চলে যায়। কিন্তু কারখানাগুলো আবার চালু হয়ে যায়। সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী যে এদের থামানো সহজ নয়।

এদিকে এই গ্রামে খাঁটি দুধ উৎপাদনকারীদের অবস্থাও শোচনীয়। গবাদি পশু পালনকারী মিরাজুল নামের এক ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা কষ্ট করে দুধ উৎপাদন করি। কিন্তু এই ভেজাল দুধের কারণে দামের দিক থেকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারি না। মাঝেমধ্যে সংগ্রহ কেন্দ্রগুলোও খাঁটি দুধ কিনতে চায় না। কারণ তারা আসলের সঙ্গে ভেজাল দুধ মিশিয়ে বেশি লাভ করতে চায়!

দুধ থেকে ননি আলাদা করার পর সেটি বড় আকারের চৌকোনা কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। এটি থেকে তৈরি হয় ছানা। তৈরি হয়ে গেলে সেটি ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তোলা হয়। কাড়াইয়ে থাকা দুধের ঘোলা পানিই তখন নকল দুধ তৈরির প্রধান উপকরণ। প্রতিমণ ছানার পানিতে ১ কেজি ননি, সামান্য পরিমাণ লবণ, খাবার সোডা, ১ কেজি চিনি, পরিমাণমতো কস্টিক সোডা, স্কিমড মিল্ক পাউডার ও পামওয়েল তেল মিশিয়ে ব্লেন্ড করে অবিকল দুধ তৈরি হয়ে যায়। কাজ শেষ হলে এটি রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া আসল না নকল বোঝার উপায় থাকে না। শেষে দুধকে তাজা দেখাতে মেশানো হয় ফরমালিন। দুধের ঘনত্ব নির্ণয়ে ল্যাকটোমিটার ব্যবহার করে ভেজাল শনাক্ত করা যায় বলে ফরমালিনসহ স্কিমড মিল্ক পাউডার ব্যবহার করা হয়।

সিরাজগঞ্জ ও পাবনা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দুধ উৎপাদনের জন্য দেশের মধ্যে এই দুই জেলা এগিয়ে। এখানে প্রতিদিন ৪ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ লিটারের কিছু বেশি দুধের চাহিদা রয়েছে। অথচ উৎপাদন হয় ৪ লাখ লিটারের কাছাকাছি। সেই হিসেবে প্রতিদিন ঘাটতি থাকে ৫০ হাজার লিটার। রমজান ও ঈদের আগে এই ঘাটতির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। এখন উৎপাদিত দুধের মধ্যে এক লাখ ৩০ হাজার লিটার থেকে দেড় লাখ লিটার নেয় বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা, দুই লাখ লিটার দুধ নেয় বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। আর ঘোষরা ৬৫ থেকে ৭০ হাজার লিটার, দুই শতাধিক মিষ্টির দোকান ২৫ হাজার লিটার এবং হাট-বাজারে স্থানীয় ক্রেতারা প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার লিটার দুধ কেনেন। অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল দুধ তৈরি করে দুধের এই ঘাটতি পূরণের সুযোগ নিয়ে থাকে। টাকার অংকে প্রতিরাতে তাদের লাভ হয় (৬০ টাকা কেজি হিসেবে) প্রায় অর্ধকোটি টাকা।

কারা চালাচ্ছে সিন্ডিকেট: অনুসন্ধানকালে জানা যায়, ফরিদপুরের ডেমরা গ্রামে ভেজাল দুধ কারবারে মূল ভূমিকা পালন করছে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। এরা মূলত তিনটি স্তরে কাজ করে। প্রথমত ভেজাল দুধ তৈরির জন্য প্রথমে স্থানীয় ক্ষুদ্র দুধ ব্যবসায়ী ও খামারিদের সঙ্গে চুক্তি করে। কম দামে তাদের দুধ কিনে এবং প্রয়োজনে আর্থিক প্রলোভন দিয়ে ভেজাল মিশ্রিত দুধ সরবরাহে বাধ্য করে। গ্রামের ভেতরে এবং আশপাশে গড়ে তোলে একাধিক কারখানা। এসব কারখানার মালিকরা এই সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করে। প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা লেনদেনও হয় এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।

সিন্ডিকেট সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ফরিদপুর গ্রামের শফি প্রামাণিক, ডেমড়া বাজারের আব্দুল আলীম, আরকান্দি বাজারের সাইদুল ইসলাম, মৃধাপাড়া গ্রামের সরোয়ার।

এদের নির্দেশনা মতো কাজ করতে টিমে আরও রয়েছেন ডেমড়া বাজারে ২৫ থেকে ৩০ জন, অরকান্দি বাজারে ১৩ জন, পারফরিদপুর এবং গোপালনগর এলাকায় ৬০ থেকে ৭০ জন ব্যক্তি। এরা সকলেই নকল দুধ তৈরি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এজেন্টদের মাধ্যমে সরবরাহ করে থাকেন। এছাড়া বড়াল নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে তোলা নকল দুধের কারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন সেখানকার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মোগলা ঘোষ, আরিফ ঘোষ, আমজাদ ঘোষ, সাগর ঘোষ, সোহেল ঘোষ, জুয়েল ঘোষ ও আরিফ ঘোষ।

এরা সবাই বড় ডিলার। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে তাদের নকল দুধ সরবরাহের নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে পাশের সাঁথিয়া উপজেলার আনাইকোলা গ্রামের ওয়াজেদ ঘোষ ও সাজু ঘোষের নকল দুধ তৈরির মালামাল আদান-প্রদানের ব্যবসা রয়েছে। আবার ফরিদপুর ও সাঁথিয়ার এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জেলার আরও বেশ কিছু ব্যবসায়ী জড়িত।

এদের মধ্যে রয়েছেন আব্দুর রশিদ, নাজমুল, আব্দুল কুদ্দুস, সরোজিৎ কুমার ঘোষ, দুলাল চন্দ্র ঘোষ, বিশ্বনাথ ঘোষ, পরিমল ঘোষ, পরিতোষ ঘোষ, দুলাল ঘোষ, রবি ঘোষ, নবরত্ন ঘোষ, মেজর ঘোষ, নবকুমার ঘোষ, রঞ্জিত কুমার ঘোষ, অধির কুমার ঘোষ, রঘু ঘোষ, প্রেমকুমার ঘোষ, মিঠু ঘোষ, বাচ্চু ঘোষ, জিকরুল, উত্তম, নরেন হালদার, প্রশান্ত, রঞ্জন, সাধন ঘোষ, অখিল, এমদাদুল, ইসলাম, আমিরুল, পরিতোষ ঘোষসহ আরও অনেক।

অভিযুক্তরা বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে মোটা টাকা জরিমানা গুনেছেন। কিন্তু নকল দুধ তৈরি এবং সরবরাহ বন্ধ রাখেননি তারা।

শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ির খামারি আব্দুল আলিম নামের একজন বলেন, গো-খাদ্যের তুলনায় দুধের দাম বাড়েনি। দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলো ৪ দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ফ্যাটের (ননি যুক্ত) দুধ প্রতি লিটার ৫২-৫৭ টাকা দরে কিনছে। এই মানের দুধ খুব কম উৎপন্ন হয়। খোলা বাজারে প্রতিলিটার দুধ ৬৫-৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খোলা বাজারে দুধের চাহিদা বেশি থাকায় এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ কম থাকার সুবিধা নিচ্ছে অসাধু এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। এরাই নকল দুধ ও ঘি বাজারজাত করে এই শিল্পের বারোটা বাজাচ্ছে।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. মাহমুদা আরা বলেন, ভেজাল ঘি ও দুধের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। এতে ব্যবহৃত কেমিক্যাল যেমন সোডা, ডিটারজেন্ট এবং সয়াবিন তেল শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। এসব উপাদান হজম প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটায়, লিভার ও কিডনির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং ক্যানসারের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পাশাপাশি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং পেটের আলসারের মতো জটিল রোগ দেখা দিতে পারে।

উল্লাপাড়ার সাবেক নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান বহু নকল দুধ কারখানায় অভিযান পরিচালনা করেছেন। তিনি বলেন, নকল দুধ তৈরি, কেনা-বেচা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুধ সংগ্রহ, মিষ্টিজাত খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত ও সরবরাহের অভিযোগটি চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। অনেক কুলিং সেন্টার ও মিষ্টির কারখানাকে ৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে মোটা অংকের জরিমানা করেছি। কিন্তু নজরদারি না রাখলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন।

শাজাদপুরের নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, আমরা অভিযোগ পেলেই অভিযান পরিচালনা করি। সবসময় সতর্ক থাকার চেষ্টা করি।

এলবি/এসএইচএস/জিকেএস

Read Entire Article