দেশ রক্ষায় ছেলেকে আন্দোলনে পাঠান আহত সজিবের মা

20 hours ago 6

ফরিদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জেলার সিভিল সার্জনের সরকারি তালিকা অনুযায়ী আহতের সংখ্যা ৯০ জন। এদের মধ্যে কেউ গুলিবিদ্ধ, কেউ রাবার বুলেটে আহত, কেউ সাউন্ড গ্রেনেডে আঘাতপ্রাপ্ত, আবার কারো বা হাত-পা ভেঙে গেছে। অনেকের চোখে আঘাত লেগেছে। হাতের কিংবা পায়ের আঙুল ভেঙে গেছে। এদের মধ্যে অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে সেরে উঠলেও এখনো পুরোপুরি সুস্থ হননি সজীব ইসলাম সানি (২৪)।

বর্তমানে তিনি ঢাকার সিআরপিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সজীব ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের রসায়ন বিভাগে অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তার বাবা মৃত আব্দুল মালেক পেশায় গাড়িচালক। বিধবা মা আর ছোট একটি বোনকে নিয়ে থাকেন শহরের বায়তুল আমান এলাকায়। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোনটি ফরিদপুর কমার্শিয়াল কলেজের ছাত্রী।

প্রতিদিনের মতো ৪ আগস্ট সকালে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে বের হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন সানি। থানা রোডে এসে সাউন্ড গ্রেনেড আর কাঁদানে গ্যাসের শিকার হন। আত্মরক্ষার জন্য হিতৈষী স্কুলের দিকে গেলে সেখানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ তার ওপর হামলা করে। তারা তাকে বেধড়ক পিটিয়ে সারা শরীর থেঁতলে দেয়। এ ছাড়া ডান হাতও ভেঙে দিয়েছে। দ্রুত তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় সিএমএইচে পাঠানো হয়। হাতে অপারেশন করে রড ঢুকিয়ে দেওয়া হলেও হাতের কব্জি এখন আর কাজ করে না। হাড় ভাঙার পাশাপাশি তার নার্ভ ড্যামেজ হয়ে গেছে। গত ১৬ নভেম্বর সাভারের সিআরপিতে ভর্তি হন তিনি। সেখানেই চিকিৎসা চলছে তার। এখানে তিনি বিনামূল্যেই চিকিৎসা পাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

সজীব জানান, টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি সংসারও চালাতেন তিনি। এখন তিনি নিজেই পরের অনুগ্রহে চলছেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এই সদস্যের অসুস্থতা গোটা পরিবারকে রীতিমতো ভোগাচ্ছে।

তিনি আরও জানান, আহত হয়ে হাসপাতালের চিকিৎসার খরচ তার নিজেকেই জোগাতে হয়েছে। পরে হাতের অপারেশনের সময় তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিনামূল্যে করে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে রড, স্ক্রু ও অনান্য ঔষধের খরচ তাকেই দিতে হয়েছে।

ফরিদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তালিকায় ৩২ নম্বরে তার নাম রয়েছে। আহত সজীবকে সম্প্রতি ফরিদপুরের ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে ৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে। 

ফরিদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুতর আহত শিক্ষার্থী এই সজীব ইসলাম সানি। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো না। সরকারি ও বেসরকারি যে কোনোভাবেই হোক দরকার তার পাশে দাঁড়ানো।

সজীবের বড় বোন মৌসুমি বলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সজীব অসুস্থ। তাই আর্থিক সংকট অনেক বেড়ে গেছে। তার চিকিৎসা চালাতেও আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। সরকারের কাছে তার চাওয়া- চিকিৎসার অভাবে যেন সজীবের মতো মেধাবী ছাত্রের জীবন ঝরে না যায়।

তিনি বলেন, আমি শ্বশুরবাড়িতে থেকে যতটুকু সম্ভব সামান্য সহযোগিতা করছি। এতে একটা পরিবারের জন্য কতটুকুই বা হয়! আমাদের পরিবারটি আজ নিঃস্ব প্রায়। 

সজীবের মা শাহিনুর আক্তার বলেন, আমি আমার সন্তানকে বলেছি হাজার মায়ের ছেলেরা আজ বিপদমুখী। তুমি যাও, দেশকে রক্ষা করো। ধার-দেনা করে খেয়ে না খেয়ে অনেক অভাবে, কষ্টে জীবন পার করলেও আমি গর্বিত আমার সন্তান জীবনবাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে। ওর বাবা নেই। সজীবের টিউশনির টাকায় আমাদের পুরো সংসার চলত। বর্তমানে খেয়ে, না খেয়ে জীবন পার করছি কোনোমতে। সরকার যেন আমাদের জন্য স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা করে দেয়। 

ছোট বোন সামান্তা আফরোজ স্নেহা বলেন, আমি এ বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থী। আমাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জন করা ব্যক্তি আমার ভাই। ভাইয়ার টিউশনির টাকায় আমাদের পুরো পরিবার চলত। এখন তো ভাইয়া নিজেই অসুস্থ। আমাদের এখন দু’মুঠো ভাত খেতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আমি পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে পারছি না অর্থের অভাবে। 

তিনি তার ভাইয়ের উন্নত চিকিৎসা এবং স্থায়ীভাবে কর্মের ব্যবস্থা করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের কাছে।

সজীবের বন্ধু আনিছুর রহমান সজল বলেন, আমরা ঐদিন একই সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেই। কিন্তু রাবার বুলেট আর কাঁদানে গ্যাসে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। ঠিক ওই সময় শহরের বড়ইতলায় ছাত্রলীগের হায়েনা বাহিনী সানির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে সানি গুরুতর আহত হয়। সে দৃশ্যটি মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। সানি এখন পঙ্গু অবস্থায় ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি আছে। ওর উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। ওর পরিবার আর্থিকভাবে খুবই দুর্বল। সরকারের কাছে ওর পরিবারের জন্য সহযোগিতা চান বন্ধু সজল। 

এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ও জেলা ছাত্রদল সভাপতি সৈয়দ আদনান হোসেন (অনু) বলেন, ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ফাসিস্ট সরকার শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে সজীবের মতো মেধাবী স্টুডেন্ট আজ পঙ্গু অবস্থায়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে চাওয়া দেশে সংস্কারের কাজ চলছে, সেই সঙ্গে যেন সজীবের মত একটি মেধাবী ছাত্রের প্রাণ অকালে ঝরে না যায়। সরকারিভাবে এদের জন্য সহায়তার ব্যবস্থা যেন করা হয়।

এ বিষয়ে ফরিদপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবরার নাদিম ইতু বলেন, ফরিদপুরে আন্দোলনে আহতদের জন্য আমরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে কিছু সাহায্য করেছি। 

তিনি সরকারের প্রতি আহতদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

Read Entire Article