দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষায় করণীয়

1 month ago 8

দেশীয় প্রজাতির মাছ খেতে পছন্দ করেন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন। মাছে-ভাতে বাঙালির প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় একটা বড় অংশজুড়ে থাকে মাছ। দেশীয় মাছ শুধু আমাদের খাদ্য চাহিদা মেটায় না, বরং পুষ্টি, জীবিকা এবং দেশের অর্থনীতির সঙ্গেও নিবিড়ভাবে জড়িত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় অনেক মাছ।

বর্ষাকাল বাংলাদেশের মৎস্য খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় দেশীয় মাছের প্রজনন ঘটে। তবে পোনার অবাধ শিকার এবং প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে মাছ ধরার ফলে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে দেশীয় মাছের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়তে পারে।

একসময় দেশি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ গ্রাম-গঞ্জের হাটবাজারে দেখা মিলত প্রচুর। এখন আর সেসব মাছ খুব একটা দেখা যায় না। সুস্বাদু দেশি প্রজাতির এসব মাছ জেলেদের জালেও ধরা পড়ে খুব কম।

দেশীয় মাছের মধ্যে রয়েছে-কৈ, মাগুর, শিং,পাবদা, টেংরা, পুঁটি, ডারকা, মলা, ঢেলা, চেলা, শাল চোপরা, শোল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বুড়াল, বাইম, খলিসা, ফলি, চিংড়ি, মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, চেং, টাকি, চিতল, গতা, পোয়া, বালিয়া, উপর চকুয়া, কাকিলা, গুত্তুম, গজার বৌরানীসহ প্রায় ৫০টিরও বেশি বিভিন্ন মাছ।

বর্ষার পানিতে গ্রাম-গঞ্জের খাল-বিল, নদী-নালা ভরে ওঠে প্রাণচাঞ্চল্যে। এই সময়েই শুরু হয় দেশীয় মাছের প্রজনন মৌসুম। মা মাছগুলো ডিম ছাড়ে এবং নতুন পানির স্রোতে পোনা মাছগুলো অবাধে ঘুরে বেড়ায়। কিছুদিনের মধ্যেই এসব পোনা বড় হয়ে পরিণত মাছ হওয়ার কথা।

কিন্তু এক শ্রেণির মৎস্য শিকারি ও সাধারণ মানুষ এই সময়ে নির্বিচারে পোনা মাছ ধরায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে এসব মাছ বড় হয়ে ওঠার সুযোগই পায় না। দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পেছনে অন্যতম বড় কারণ হয়ে উঠেছে এই পোনা নিধন। যদি এভাবে চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে দেশীয় মাছের অনেক প্রজাতিই কেবল স্মৃতিতে রয়ে যাবে। তাই এখনই প্রয়োজন দেশীয় মাছ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রজনন ব্যবস্থার যথাযথ উন্নয়ন।

বর্ষাকালে মাছের প্রজনন, পোনা মাছ নিধনের ক্ষতিকর প্রভাব এবং দেশীয় মাছ টিকিয়ে রাখতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, এসব বিষয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড

জাগো নিউজ: বর্ষাকাল মাছের প্রজননের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ড. মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: বাংলাদেশের বেশিরভাগ দেশীয় মাছের প্রজনন ঘটে বর্ষাকালেই। তাই এ সময় মাছের প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাছের প্রজনন না হলে একদিকে যেমন মাছের বংশবৃদ্ধিও ঘটবে না, অন্যদিকে দেশ থেকে এক সময় এসব মাছও হারিয়ে যাবে। দেশি মাছের প্রজনন শুরু হয় প্রধানত মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। তবে মাছের প্রজননের সময়কাল তারতম্য হতে পারে স্থানভেদে। বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গা তুলনায় সিলেট অঞ্চলে তাড়াতাড়ি প্রজনন শুরু হয়। এই অঞ্চলের মাছের প্রজনন মৌসুম অন্যান্য জায়গায় তুলনায় এক থেকে দেড় মাস আগে শুরু হয় কারণ এখানে বৃষ্টিপাত আগে শুরু হয়। যার ফলে বর্ষাকালের আগেই কখনো কখনো সিলেট অঞ্চলে দেশীয় মাছগুলোর প্রজনন শুরু হয়ে যায়।

জাগো নিউজ: কোন কোন দেশীয় মাছ বর্ষাকালে ডিম ছাড়ে?
ড. মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: বর্ষাকালে সাধারণত অধিকাংশ মাছই ডিম ছাড়ে, বর্ষাকে মাছের প্রজননের জন্য মৌসুম বলা হয়ে থাকে। দেশের মূলত দুই ধরনের মাছের প্রজনন হয়, বড় মাছের মধ্যে কার্প জাতীয় অন্যদিকে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছগুলো। বড় কার্প জাতীয় মাছগুলো ডিম ছাড়ে বর্ষাকালের ফুল মৌসুমে মে মাস থেকে আগস্টের মধ্যে। তবে সিলেট অঞ্চলে তা মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে হয়। বড় মাছের মধ্যে কার্প জাতীয়, কার্নিভোরাস ফিস বা স্নেক হেডেড মাছগুলো রয়েছে যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল, গজার, আইড়, বোয়াল ইত্যাদি।

সিলেট অঞ্চলের ছোট মাছের প্রজনন শুরু হয় এপ্রিল থেকে মে এর মধ্যে যখন প্রথম বৃষ্টিপাত শুরু হয়। দেশের অন্যান্য জায়গায় এর অনেক পড়ে হয়। ছোট মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মাছ।

জাগো নিউজ: দেশীয় মাছ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে পোনা ধরার ভূমিকা কতটা?
ড. মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: দেশীয় মাছ হারিয়ে যাওয়া পেছনে অবশ্যই অন্যতম কারণ পোনা নিধন বা পোনা মাছ ধরা। পোনা অবস্থায় ধরে ফেললে মাছ আর বড় হতে পারবে না, আর বড় না হলে পরবর্তী বছরগুলোতে প্রজনন করতে পারবে না। অন্যদিকে অল্প পরিসরে লিজ হোল্ডার যারা প্রধানত তিন বছর বা পাঁচ বছরের জন্য পুকুর বা ছোট ছোট বিল নিয়ে থাকে, মেয়াদ শেষ হলে তারা সেচ দিয়ে সব মাছ ধরে ফেলে এমনকি ছোট পোনাও। একই সঙ্গে বিষ প্রয়োগে কাঁদার সঙ্গে মিশে থাকা প্রজাতির মাছগুলোও ধরে ফেলে। এতে আর কোনো মাছই থাকে না।

জাগো নিউজ: দেশীয় মাছ হারিয়ে গেলে আমরা কি ক্ষতির মুখে পড়বো?
ড. মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: পোনা মাছ ধরার ফলে দেশের মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে, কারণ মা মাছ ডিম ছাড়ার পর যদি মাছগুলো ধরে ফেলে বা ঠিকভাবে বড় হতে নাই দেয় তাহলে ধীরে ধীরে দেশীয় মাছ প্রজাতি হারিয়ে যাবে। বর্তমানে দেশে অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছ সংকটাপূর্ণ আর কিছুদিন এভাবে চলতে থাকলে দেশীয় মাছগুলো আর দেখতে পাওয়া যাবে না। দেশীয় ছোট মাছ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী।

মলা, ঢেলা, চান্দা, পুঁটি, টেংরা, কাচকি, বাতাসি মাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, জিংক, আয়রন, ফসফরাস, প্রোটিন, ভিটামিন ডি রয়েছে। যা চোখ ভালো রাখতে সাহায্য করে। তাই এসব মাছ হারিয়ে গেলে আমরা বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বো।

জাগো নিউজ: পোনা ধরা রোধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?
ড. মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: পোনা মাছ ধরা রোধ করতে গেলে অবশ্যই প্রথমে পোনা নিধন বা ধরা বন্ধ করতে হবে। পোনা ধরা রোধের জন্য দুই ধরনের সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। পাবলিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, জেলেদের মাঝে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বা মেম্বারদের মাধ্যমে খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ (যেমন ছোট সাইজের মাছ ধরা নিষেধ, অবৈধ জাল ব্যবহার করা নিষেধ (ফাঁস জাল), একদম প্রজনন সিজনে মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে।ইলিশ ধরা বন্ধের সময় যেমন জেলের জন্য আলাদা করে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করা হয় ঠিক তেমনি দেশীয় প্রজাতির ক্ষেত্রেও করতে হবে। পরিশেষে দেশে প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করতে হবে অবশ্যই পোনা ধরা থেকে বিরত থাকতে হবে।

জাগো নিউজ: মানুষকে সচেতন করতে কী কী করা প্রয়োজন?
ড. মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড: মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পোনা নিধন রোধে মাইকিং করা, বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে, যেখানে স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন, এলাকাবাসী বা সুযোগ থাকলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা মৎস্য গবেষকদের যুক্ত করা। তারা ক্যাম্পেইনে পোনা ধরার ক্ষতিকর বিষয় এবং দেশীয় মাছের উপকারিতা আলোচনা করবেন। প্রত্যেক বছর এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।

আরও পড়ুন

কেএসকে/এমএস

Read Entire Article