দেড় যুগেও হাসপাতাল জোটেনি কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের

9 hours ago 4

প্রতিষ্ঠার দেড়যুগেও পূর্ণতা পায়নি কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ (কমেক)। অনেক পরে যাত্রা করা মেডিকেল কলেজগুলো হাসপাতালসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা পেলেও অজানা কারণে পিছিয়ে পড়েছে পর্যটন নগরীর এই প্রতিষ্ঠানটি। কলেজের সঙ্গে ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল হওয়ার কথা থাকলেও দেড়যুগেও সে অভাব রয়ে গেছে। এতে প্রতিষ্ঠানটির ইন্টার্ন চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একইসঙ্গে চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন জেলার ২৮ লাখ বাসিন্দা ও পর্যটকরা। এছাড়া পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও জনবলের অভাবে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এসব নানাবিধ সমস্যাকে দূর করে কলেজটিকে পূর্ণতা দানে সরকারের সুদৃষ্টি প্রত্যাশা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।

হাসপাতাল নির্মাণসহ প্রতিষ্ঠানটিকে পূর্ণতা দিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিভিন্ন সময়ে কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ শুক্রবার (১৪ মার্চ) জাতিসংঘ মহাসচিবকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কক্সবাজার সফরের আগের দিনও শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করেন। এছাড়া ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপিও দেন তারা।

শিক্ষার্থীরা জানান, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের একটি ছোট ইউনিটে ২০০৮-২০০৯ সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে কমেকের যাত্রা। মেডিকেল শিক্ষার উল্লেখযোগ্য বিষয় ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ হওয়ায় বিএমডিসির নিয়মানুসারে প্রতিটি মেডিকেল কলেজের টিচিং হাসপাতাল থাকা আবশ্যক। কিন্তু ১৭ বছরেও কমেক শিক্ষার্থীরা স্বতন্ত্র হাসপাতাল পাননি। অথচ হাসপাতাল এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের ল্যাবরেটরি হিসেবে কাজ করে। তৃতীয় বর্ষ হতেই হাসপাতালে ওয়ার্ড ডিউটি করতে হয় শিক্ষার্থীদের।

দেড় যুগেও হাসপাতাল জোটেনি কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের

শিক্ষার্থীরা বলেন, ২০১৭ সালের ৬ মে কমেক হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপন করলেও অদ্যাবধি নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। অন্যদিকে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিতি মেডিকেল কলেজ ৬ বছর পর এবং ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ ৪ বছর হাসপাতাল পেয়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ চলছে। শিক্ষার্থীরা এসব তথ্য তুলে ধরে তারা পিছিয়ে কেন, এমন প্রশ্ন করেন?

শিক্ষার্থীদের মতে, একে একে ১৭টি ব্যাচ পেরিয়েছে কলেজটি। নানা অপ্রাপ্তির মাঝেও চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ফাইনাল প্রোফেশনাল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে কমেক। এরইমধ্যে ১১টি এমবিবিএস ব্যাচ বের হয়েছে। এভাবে বছরান্তে বাড়ছে শিক্ষার্থী সংখ্যা। তবুও কাটেনি সংকট ও অনিশ্চয়তা। দীর্ঘ ১৭ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি স্থায়ী ৫০০ শয্যা আধুনিক হাসপাতাল। দীর্ঘ ৮ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নিয়মিত ক্লিনিক্যাল ক্লাসে জেলার ২৫০ শয্যার হাসপাতাল অস্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। যা সময় সাপেক্ষ ও ভোগান্তির। এতে বছরান্তে প্রায় ৫৯৮ ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন, প্রায় ২৮ লাখ জনগোষ্ঠীর সেবায় কক্সবাজার জেলা সদরে মাত্র ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল রয়েছে। এতে প্রতিদিন ৫-৬ হাজার রোগী চিকিৎসা নেন, ভর্তি থাকেন ৭০০-১০০০ রোগী। অতিরিক্ত রোগী ফ্লোরে কিংবা সিঁড়ির পাশে, করিডোরে অবস্থান নেন। সঙ্গে রয়েছে ১৩ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার চাপ। এছাড়াও রয়েছে হেমাটোলজি, হেপাটোলজি, সাইকিয়াট্রি, নিউরোমেডিসিন, নিউরোসার্জারি, এনআইসিইউসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের সংকট। কোনো বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট নেই। এ বিভাগগুলোর সংকটে প্রায়ই রোগীকে স্থানান্তর করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেলে বা ঢাকায়। কিন্তু শত শত কিলোমিটার দূরত্ব ও খরচের কারণে অনেক রোগীর অন্যত্র যাওয়া হয় না। অথচ সকল সুবিধা সম্বলিত কমেকের ৫০০ শয্যার মেডিকেল হাসপাতালটি পূর্ণতা পেলে স্বাস্থ্য সেবার সংকট সহজেই দূর হতো।

শিক্ষার্থীদের মতে, সদর হাসপাতালের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন কিংবা গবেষণা চর্চা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে। কক্সবাজারে প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন, কিন্তু পর্যটনকেন্দ্রিক উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন হলে পর্যটক ও স্থানীয়রা উন্নত চিকিৎসা পাবেন।

দেড় যুগেও হাসপাতাল জোটেনি কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের

তারা আরও জানান, পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্যাকেজ সিসিজিপি কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে পুরোদমে নির্মাণ কাজ চলছে। একই প্রকল্পে কমেক হাসপাতালসহ আরও তিনটি হাসপাতাল ভবন রয়েছে। কিন্তু পামেক হাসপাতাল ভবনের কাজ চললেও কমেক হাসপাতাল ভবন নির্মাণের দরপত্রও এখনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পায়নি। কমেক হাসপাতালের পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থাপিত হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স ও অন্যান্য পদ সৃষ্টি হবে। নির্মাণ হবে চিকিৎসকগণের কোয়ার্টার, ইন্টার্ন হোস্টেল, ডক্টরস ডরমিটরি, নার্স ডরমিটরি, অধ্যক্ষের বাসভবন, পরিচালকের বাসভবন, স্টাফ কোয়ার্টার, ইত্যাদি এনসিলারি ভবনও। তখন মেডিকেল হাসপাতালে একটি পরিপূর্ণ ও মানসম্পন্ন চিকিৎসা প্রদান সম্ভব হবে।

শিক্ষার্থীরা পর্যটন নগরীতে স্বল্প খরচে এমআরআই, সিটি স্ক্যান, এনজিওগ্রাম, ডায়ালাইসিস, আইসিও, সিসিও, স্ক্যানোসহ জটিল রোগ নির্ণয় এবং আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে কমেক হাসপাতাল স্থাপনে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আন্তরিক সুদৃষ্টি কামনা করেন।

আরও পড়ুন:

কলেজ সূত্র জানায়, কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার জানার ঘোনায় ৩৩ একর জায়গায় কমেক স্থায়ী ক্যাম্পাসের অবস্থান। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কমেক কার্যক্রম শুরু হয়। একজন অধ্যক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ৮৯ টি শিক্ষকের পদ থাকলেও অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষকসহ নানা পদ এখনো শূন্য। অপর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়ে জোড়াতালিতে চললেও ফাইনাল পরীক্ষায় চট্টগ্রামের ১৪টি মেডিকেল কলেজের পাশের হারে শীর্ষে থাকে কমেক। শিক্ষক ছাড়াও রয়েছে কর্মচারী সংকটও। এতে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে ব্যাঘাত ঘটছে।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদুল হক বলেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা একটি বড় সমস্যা। স্থানীয় ও রোহিঙ্গা মিলিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোগীর চাপ অনেক। তাই কমেকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ হলে চিকিৎসা জট কমে সেবার মান বাড়বে।

কমেক অধ্যক্ষ ডা. সোহেল বক্স বলেন, কমেকে পিসিআর ল্যাব স্থাপন হওয়ায় কোভিড-১৯ শুরুর পর ২০২০ এর এপ্রিল হতে এ পর্যন্ত ৪ লাখের বেশি আরটিপিসিআর পরীক্ষার আওতায় এসেছে কমেক ল্যাবে। যা সারা দেশে বিরল। কমেক হাসপাতালটি পূর্ণতা পেলে এখানকার চিকিৎসা সেবা বহুলাংশে এগিয়ে যাবে। এসব বিষয় তুলে ধরে ঊর্ধ্বতন মহলে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

এমএন/জেআইএম

Read Entire Article