সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নশ্চিত করতে ধীর গতির প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো এবং দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংশোধন করা হচ্ছে। এই সংশোধিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নের পদ্ধতি কীভাবে হবে তা ঠিক করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করেছে। ওই নির্দেশনায় ধীরগতি সম্পন্ন প্রকল্প থেকে বরাদ্দ হ্রাস করে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পরিবেশ ও জলবায়ু, কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্যা-উত্তর পুনর্বাসন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো পদ্ধতির আওতায় সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সুষ্ঠু ও সময়মত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংশোধিত বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলন অবশ্যই মূল বাজেটে প্রদর্শিত মোট ব্যয়সীমার (পরিচালন ও উন্নয়ন) মধ্যে সংকুলানযোগ্য হতে হবে। কোনোভাবেই অতিরিক্ত বরাদ্দ দাবি করা যাবে না।
এই সংশোধিত বাজেটে এডিপি প্রণয়ন পদ্ধতি ঠিক করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের ক্ষেত্রে পিএল/জি অংশে সম্পূর্ণ ব্যয় করা যাবে এবং সেক্ষেত্রে জিওবি অংশে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান রাখতে হবে।
সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্প সংখ্যা সীমিত রাখতে নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকারের কৌশলগত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর আলোকে অগ্রাধিকার ঠিক করে প্রয়োজনে অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) মূল অংশে বরাদ্দবিহীনভাবে কোনো প্রকল্প রাখা যাবে না বলেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, একই সংস্থার আওতায় বাস্তবায়িতব্য একই উদ্দেশ্য/প্রকৃতির একাধিক ক্ষুদ্র প্রকল্প প্রস্তাব পৃথকভাবে প্রণয়ন না করে একত্রে একটি প্রকল্পের (গুচ্ছ প্রকল্প) আওতায় প্রস্তাব করতে হবে। সংশোধিত এডিপিতে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ও মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপি বরাদ্দবহির্ভূত যেসব প্রকল্প এরই মধ্যে অনুমোদিত ও বরাদ্দপ্রাপ্ত হয়েছে সেসব প্রকল্প আরএডিপিতে বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত করতে নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপি-তে যেসব প্রকল্প আন্তঃসমন্বয় করা হয়েছে আরএডিপি-তে তার যথাযথ প্রতিফলন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত প্রকল্প এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এমন সব প্রকল্প সংশোধিত এডিপিতে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
সংশোধিত এডিপি’র ক্ষেত্রে আরও যে সব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে
• ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত’ অথবা ‘এসপিইসি কর্তৃক অনুমোদনের জন্য সুপারিশকৃত’ এবং ‘বৈদেশিক ঋণ/অনুদান চুক্তি সম্পাদিত অথবা বৈদেশিক ঋণ/অনুদান প্রাপ্তির সুনিশ্চিত অঙ্গীকারপ্রাপ্ত প্রকল্প’ ব্যতীত কোনো অননুমোদিত কারিগরি সহায়তা প্রকল্প সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা যাবে না।
• ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে এলাকা/অঞ্চলভিত্তিক সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
• চলতি প্রকল্পগুলোর অনুমোদিত প্রকল্প দলিলে উল্লিখিত প্রাক্কলিত ব্যয় এবং এ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জীভূত ব্যয়ের ভিত্তিতে যুক্তিসংগত ও সম্ভাব্য ব্যয়ের বিবেচনায় সংশোধিত এডিপিতে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করতে হবে। প্রকল্প ঋণ/অনুদান বরাদ্দের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত বরাদ্দ চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হবে।
• বৈদেশিক ঋণ/অনুদান (‘ঋণ/অনুদান স্বাক্ষরিত’/‘ঋণ/অনুদান প্রাপ্তি সুনিশ্চিত’) প্রকল্পের ক্ষেত্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রাপ্য বৈদেশিক ঋণ/অনুদান ব্যবহারের নিমিত্ত পরিপূরক স্থানীয় মুদ্রা বরাদ্দের দাবি/প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
• ধীরগতি সম্পন্ন প্রকল্প হতে বরাদ্দ হ্রাস করে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। এছাড়া, বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পরিবেশ ও জলবায়ু, কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বন্যা-উত্তর পুনর্বাসন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
• চলমান উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় স্থানীয় মুদ্রার বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ সাপেক্ষেই শুধু অপরিহার্য নতুন প্রকল্পের জন্য স্থানীয় মুদ্রার বরাদ্দ প্রস্তাব করতে হবে।
• সরকারের আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করের হার এবং আমদানি পণ্য মূল্যের নির্ধারিত বিনিময় হার অনুযায়ী সিডি/ভ্যাট বাবদ প্রয়োজনীয় বরাদ্দের সংস্থান পৃথকভাবে না রেখে বরং যেসব মূলধনি ক্রয়ের জন্য মূলধন খাতে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেসব মূলধনি ক্রয়ের অর্থনৈতিক কোডেই সিডি/ভ্যাট বাবদ অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।
উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ দেওয়া এডিপিবহির্ভূত স্কিমের সংশোধিত প্রাক্কলন পদ্ধতি
চলতি অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত চলমান স্কিম এবং এরই মধ্যে নতুন কোনো স্কিম অনুমোদিত হয়ে থাকলে অনুমোদিত নতুন স্কিমের জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব প্রাক্কলনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অননুমোদিত কোনো স্কিমের জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা যাবে না। স্কিমের সব ব্যয় অবশ্যই বিস্তারিত অর্থনৈতিক কোড অনুযায়ী প্রদর্শন করতে হবে। অনুমোদিত স্কিমের ক্ষেত্রে অনুমোদিত মোট ব্যয়সীমা যেন অতিক্রান্ত না হয় এর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
গত ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব দেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ বাজেটে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। আর এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয় ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেট পাস হওয়ার পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে গত ৮ আগস্ট দেশ চালানোর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাস পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলো।
এদিকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা টাকার অংকে ১৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। তবে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ২ দশমিক ১৮ শতাংশ বা ৬ হাজার ৭২ কোটি টাকা।
এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই একই সময়ে এডিপি বাস্তায়নের হার ছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এছাড়া গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুধু সেপ্টেম্বরে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এমএএস/ইএ