নদী ও জীববৈচিত্র্য হারানোর ঝুঁকি ভয়ংকর

1 day ago 12

ড. ফোরকান আলী

যে পৃথিবীর ওপর আমাদের বসবাস। তা ক্রমেই ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুর্বিপাকের ছোবল আরও প্রবল হতে পারে। এমনকি মনুষ্যবসতির উপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একটি সংরক্ষণবাদী গ্রুপ তেমন আশঙ্কার কথাই জানিয়েছে। জুওলোজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন এবং গ্লোবাল ফুটপ্রিন্ট নেটওয়ার্কের এক রিপোর্টে সম্প্রতি উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাড়ে চার দশকের ব্যবধানে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক রকম ধস নেমেছে। এ সময়ে অন্তত ৩ হাজার ৩০৯ প্রজাতির বিভিন্ন জীবজন্তুর মধ্যে ১ হাজার ২৩৫টি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যার হার ৩৭ ভাগ। বর্তমানে প্রতি বছর জীববৈচিত্র্য হারানোর প্রবণতায় ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৫১ ভাগ জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে। যা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক অবনতির ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। যার প্রভাব পড়বে কৃষিজমি, বনভূমি, সাগর-সম্পদের ওপর। পরিণতিতে বেড়ে যাবে খাদ্য, পণ্য, পানি ও জ্বালানির মূল্য। ডব্লিউডব্লিউএফের আর্ন্তজাতিক মহাপরিচালকের ভাষায়, ভয়াবহ সেই পরিণতি থেকে পৃথিবী ও পৃথিবীর জীবকুলকে রক্ষায় আমাদের জীবন-যাপনের ধারায় পরিবর্তন আনতে হবে। যেসব ক্রিয়াকলাপে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার আশংকা রয়েছে, তা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।

একই গ্রুপের স্কটল্যান্ডের শাখার নীতি নির্ধারক ড. ভ্যান যারলো বলেন, বিশ্বের চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে মিডিয়া মাতামাতি করলেও জীববৈচিত্র্য নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য নেই। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে অর্থনৈতিক এ সংকটের মূল হলো বৈশ্বিক ভারসাম্য হারানো। যারা মূল জীববৈচিত্র্যের ধারাবাহিক পতন। তাই সংকট উত্তরণে নজর দেওয়া উচিত মূলে। তা না হলে অন্য যত উদ্যোগ আয়োজনই করা হোক না কেন জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা যাবে না। একই মন্তব্য করেছেন ডব্লিউপিএফ নামে লন্ডনভিত্তিক একটি পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রধান ফিলিপ অ্যালবার্ট। তার মতে, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মানুষকেই প্রথম এগিয়ে আসতে হবে। কেননা জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মূলে তারাই। মানুষ অধিকতর আয়েশি জীবন-যাপনের তাগিদে জীবজগতের ওপর হাত বাড়ায়। ফলে একে একে বিপন্ন হয় একেকটি প্রজাতি। তারই ধারাবাহিকতায় মানুষকেই এক সময় ঝুঁকির কাতারে গিয়ে ঠেকতে হয়।

অপরদিকে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা তাদের জলবায়ু প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছর বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা শিল্প-পূর্ব স্তরের তুলনায় বেশি। এমন পরিস্থিতিতে হিমবাহ ও সমুদ্রের বরফ দ্রুত গতিতে গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। রয়টার্সের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, রেকর্ড গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর ছিল ২০২৪। এতে হিমবাহ ও সাগরে বরফের ব্যাপক ক্ষয় হয়েছে। ফলে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। ১৯ মার্চ জাতিসংঘের আবহাওয়া বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) তাদের বার্ষিক জলবায়ু প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত বছর বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (২.৭৯ ফারেনহাইট), যা শিল্প-পূর্ব স্তরের তুলনায় বেশি। এমন পরিস্থিতিতে হিমবাহ ও সমুদ্রের বরফ দ্রুতগতিতে গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। আবহাওয়া সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বছরে গড়ে ৪ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে ১৯৯৩ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত এই হার ছিল ২ দশমিক ১ মিলিমিটার। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে দেশগুলো গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য সম্মত হয়েছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির রেকর্ড রাখা শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম জুন মাস ছিল ২০২৪ সালে। রেকর্ড তাপমাত্রার কারণে অন্যান্য বছরের জুন মাসের চেয়ে ২০২৪ সালের জুনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ তাপপ্রবাহ, খরা, অতিমাত্রায় বর্ষণ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগও বেশি ঘটেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান করাণ হলো-জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা রোধ করার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত ও ধনী দেশ এখন পর্যন্ত গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে কয়েক দশক ধরেই বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং তজ্জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক দুরারোগ্য রোগব্যাধি তারই একেকটি ধাপ। পরিবেশ সংরক্ষণবাদী মার্কিনভিত্তিক সংগঠন লাইফের নির্বাহী প্রধান মোরিস অ্যাসেস আরও কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তার মতে, ভোগবাদী জীবন-যাপন থেকে বিরত না থাকলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের ধারা রোধ করা যাবে না। অপরদিকে আমাদের দেশে ও জলবায়ুর মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। নদ-নদী হারিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। বিলুপ্তি ঘটছে মৎস্যসম্পদ ও পশু-পাখি। ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ প্রজাতির দেশি মাছ ও ২০ প্রজাতির পাখির বিলুপ্তি ঘটেছে। গত ৪০ বছরে প্রায় অনেক নদী ও খাল-বিল মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। এ ছাড়া গত ৪০ বছরে কয়েক হাজার একর বনভূমি বেদখল হয়েছে। উজাড় করা হয়েছে বৃক্ষ। বনভূমি উদ্ধারে মামলা করেও ভূমি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। বৃক্ষ নিধনে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে।

জীববিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনে ২০ প্রজাতির পাখির বিলুপ্তি ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে শকুন, চিল, ঘুঘু, হড়িয়াল, মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, তিলা ঘুঘু, ডাহুক, পানকৌড়ি, বগিলা, কানা বগিলা, কানা কুহু, পেঁচা, হুতুমপেঁচা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া গুইসাপ, বেজী, নেউল প্রভৃতি সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে। বিলুপ্তি ঘটেছে নন্দই, ভ্যাদা, চেলা, কানিয়া, রাখলা, পাবদা, কৈ, মৃগেল, কালিবাউশ, শোল, বাইম, ফ্যাসা, খলিশা, বাচা, বাইজা, চাপিলা, পুঁটি, সরপুঁটি, কাকিলা, আইড়, ফলি প্রভৃতি দেশি প্রজাতির সুস্বাদু মিঠা পানির মাছ। বিলুপ্ত এসব দেশি প্রজাতির মাছের বদলে স্থান করে নিয়েছে বিদেশি প্রজাতির মাছ সিলভার কার্প, জাপানি রুই, থাই পুঁটি ও থাই কৈ। বিলুপ্ত নদীর পাঙাশের স্থান দখল করে নিয়েছে পুকুরে চাষ করা পাঙাশ ও থাই চাপিলা।

জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বরেন্দ্র এলাকায়। জীববিজ্ঞানীদের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, নদ-নদী ও খাল-বিলের অস্তিত্ব হারানো, শহর, বন্দর ও গ্রামের অসংখ্য পুকুর-জলাশয় ভরাট করে বসতি গড়ে তোলা ও আবাদি জমিতে পরিণত করার ফলে দেশের জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু ও আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দেশের মানচিত্র (নকশা) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, গত ৪০ বছরে দেশের বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় কয়েক হাজারেরও বেশি পুকুর ভরাট করা হয়েছে। এসব পুকুর ভরাট করে দালান-কোঠা, বসতবাড়ি ও আবাদি জমিতে পরিণত করেছে প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীরা। এ ছাড়া আবাদি জমিতে অধিক ফলনের আশায় ব্যাপকহারে সার, কীটনাশক ওষুধ ব্যবহারে পশু-পাখি ও মাছের বিলুপ্তি ঘটছে।

নদ-নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ নদী করতোয়া, ইছামতি, বড়াল, গুমানি, আত্রাই, দইভাঙ্গা, হুরাসাগর, বুড়িতিস্তা, দইজান, নাওতারা, চাড়ারখোড়া, বুড়িকড়া, দেওনারী, খরখড়িয়া, যমুনেশ্বরী, চিকলি, মহানন্দা, ছোট যমুনা প্রভৃতি নদী মানচিত্র (নকশা) থেকে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। সেসব স্থান দেখে মনে হয় না যে, একদিন এখানে স্রোতস্বিনী নদী ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপ থেকে জানা যায়, পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা প্রভৃতি নদ-নদীর গতি-প্রকৃতিই হারিয়ে গেছে। গত ৪০ বছরে এসব নদীর তলদেশে ২৫ থেকে ৩০ ফুট বালির স্তর জমে গভীরতা হ্রাস পেয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশে সাড়ে তিন লাখ টন বালির স্তর জমছে। বছরের ৯ মাসই এসব নদ-নদী পানিশূন্য থাকে। প্রধান নদ-নদী ভরাট হওয়ায় অভ্যন্তরীণ নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আমাদের ও বিশ্ববাসীকে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার এখনই সময়।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ।

এসইউ/জেআইএম

Read Entire Article