হাসপাতাল-সংক্রান্ত সংক্রমণ (এইচএআই) জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। এর মধ্যে ক্যান্ডিডা অরিস নামের এক ধরনের ছত্রাক (ফাঙ্গাস) বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এটি সম্প্রতি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে ক্যান্ডিডা সংক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মাইক্রোবায়োলজি স্পেকট্রাম জার্নালে প্রকাশিত আইসিডিডিআর,বি-র এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ক্যান্ডিডা অরিস ছড়িয়ে পড়ছে।
আইসিডিডিআর,বি, বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সহযোগিতায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) অর্থায়নে এ গবেষণাটি পরিচালনা করেছে বাংলাদেশের দুটি টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতাল।
ক্যান্ডিডা অরিস হলো- এমন এক ধরনের ছত্রাক, যা মানুষের ত্বকে কোনো লক্ষণ দেখায় না এবং দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারে। প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে এটি সংক্রমণে রূপান্তরিত হয়। সাধারণত রক্তের মতো জীবাণুমুক্ত অঙ্গের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে, যা রোগকে অনেক বেশি প্রাণঘাতী করে তোলে।
অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মৃত্যুর হার প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত দেখা গেছে। দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন, গুরুতর অসুস্থ রোগী এবং অপরিণত নবজাতকদের মধ্যে এটি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এনআইসিইউতে থাকা অনেক নবজাতক উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এ ছত্রাক প্রায়শই একাধিক অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের প্রতিরোধী, যার কারণে ২০১৯ সালে সিডিসি এটিকে ‘অতি জরুরি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স হুমকি’ হিসেবে ঘোষণা করে।
দীর্ঘ সময় হাসপাতালের যন্ত্রপাতিতে টিকে থাকা, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং উচ্চমাত্রার অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি থাকার কারণে ক্যান্ডিডা অরিসকে ‘হাসপাতাল-সম্পর্কিত সুপারবাগ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

গবেষণাটি ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি নবজাতকদের মধ্যে পরিচালনা করা হয়। ভর্তি হওয়ার সময় এবং পরবর্তীতে রোগীদের ত্বক ও রক্ত পরীক্ষা করা হয় ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণ বা অবস্থান (কলোনাইজেশন) শনাক্তের জন্য, যাতে হাসপাতালের ভেতরে সংক্রমণের ছড়ানোর ধরণ বোঝা যায়।
গবেষণায় দেখা যায়, ৩৭৪ জন রোগীর মধ্যে ৩২ জন (৯ শতাংশ) ত্বকে ক্যান্ডিডা অরিস বহন করছিলেন, এবং একজন (০.৩ শতাংশ) রোগীর রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ ৩২ জনের মধ্যে ১৪ জন (৪৪ শতাংশ) ভর্তি হওয়ার সময়ই আক্রান্ত ছিলেন, বাকি ১৮ জন (৫৬ শতাংশ) ভর্তি হওয়ার পর সংক্রমিত হয়েছেন। ভর্তি হওয়ার সময় আক্রান্ত ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জন অন্য হাসপাতাল বা ওয়ার্ড (যেমন প্রসূতি ওয়ার্ড) থেকে স্থানান্তরিত হয়েছিল, কেবল একজন এসেছিলেন বাড়ি থেকে। সংক্রমিত ৩২ জনের মধ্যে ৭ জন (২২ শতাংশ) মারা যান, যার মধ্যে রক্ত সংক্রমিত শিশুও ছিল।
ফলাফলগুলো ইঙ্গিত করে যে, এনআইসিইউ’র ভেতরে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণ নিয়মিত ঘটছে, কারণ অর্ধেকের বেশি রোগী ভর্তি হওয়ার পরই সংক্রমিত হয়।
ফলাফলগুলো ইঙ্গিত করছে যে, এনআইসিইউতে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণ নিয়মিতভাবে ঘটছে, কারণ অর্ধেকের বেশি রোগী ভর্তি হওয়ার পরই সংক্রমিত হয়েছেন। এ ফলাফল আইসিডিডিআর,বি-র অন্য সাম্প্রতিক গবেষণার সঙ্গে মিলছে, যেখানে নতুনভাবে হাসপাতালে ভর্তি কোনো রোগীর মধ্যেই লোকালয় থেকে ক্যান্ডিডা অরিস পাওয়া যায়নি। এটি আরও প্রমাণ করছে যে, এ ছত্রাক হাসপাতালের পরিবেশেই টিকে থাকে এবং সেখান থেকেই রোগ ছড়ায়।
বর্তমান গবেষণায় দেখা যায়, ক্যান্ডিডা অরিস’র মাত্র তিনটি আইসোলেট (৯ শতাংশ) একাধিক অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের প্রতি প্রতিরোধী ছিল, তবে ৮২ শতাংশ আইসোলেট ফ্লুকোনাজোল প্রতিরোধী ছিল, যা রক্তে ছত্রাকজনিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রথম সারির ওষুধ।
উল্লেখযোগ্য যে, যেসব রোগীর মধ্যে ক্যান্ডিডা উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তাদের ৮১ শতাংশ জন্ম সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে হয়েছে। গবেষকরা ধারণা করছেন, সিজারিয়ান ডেলিভারির পর দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকার কারণে নবজাতকরা ক্যান্ডিডা অরিস’র সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেশি থাকে।
আইসিডিডিআর,বি-র সংক্রামক রোগ বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী ও এএমআর রিসার্চ ইউনিটের প্রধান ডা. ফাহমিদা চৌধুরী বলেন, ‘এই গবেষণা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে গুরুতর অসুস্থ ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের মধ্যে এ ‘সুপারবাগ’-এর সংক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দিয়েছে। এটি প্রশাসনিক ও নীতি নির্ধারণের স্তরে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রথম ধাপ।’
গবেষকরা সুপারিশ করেছেন, এনআইসিইউ ও অন্যান্য হাসপাতাল পরিবেশে ক্যান্ডিডা অরিস ছড়ানো রোধে কার্যকরী ক্লোরিনভিত্তিক জীবাণুনাশক দিয়ে নিয়মিত যন্ত্রপাতি ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র পরিষ্কার করা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের হাত ধোয়ার অভ্যাস উন্নত করা।
তারা আরও উল্লেখ করেন, এনআইসিইউতে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণের ধারাবাহিক নজরদারি চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। এর মাধ্যমে আক্রান্ত নবজাতক দ্রুত শনাক্ত ও আলাদা করা সম্ভব হবে, সংক্রমণ ছড়ানো রোধ করা যাবে এবং প্রয়োজনীয় অ্যান্টিফাঙ্গাল চিকিৎসা সময়মতো দেওয়া সম্ভব হয়।
এসইউজে/এমএএইচ/এমএস

8 hours ago
2









English (US) ·