‘নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে সরকারি নীতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন’

2 hours ago 3

নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে সরকারি নীতিতে পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব শক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। এছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরঞ্জামের ওপর উচ্চ শুল্ক ব্যবস্থার বিলুপ্তি, কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে ভর্তুকি চালু করা এবং জ্বালানি দক্ষতার জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

শনিবার (২৩ নভেম্বর) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) আয়োজিত অ্যাক্সপ্লোরিং এ সাস্টেইনেবল পাথওয়ে ফর বাংলাদেশ’স এনার্জি ট্রান্সফর্মেশন স্টুয়ার্ডস গ্রিন এ্যান্ড ক্লিন এনার্জি’ শীর্ষক এক জাতীয় পর্যায়ের সংলাপে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। এই আয়োজনে সানেম মোট তিনটি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করে।

সংলাপে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। গবেষণার ফলাফল উপস্থাপনা করেন সানেমের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী মো. তুহিন আহমেদ ও গবেষণা সহযোগী একরামুল হাসান।

গবেষণায় জ্বালানি মূল্য ওঠানামার সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রভাব: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট শিরোনামে প্রথম গবেষণায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বৈশ্বিক জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্য পরিবর্তনের প্রভাব পরীক্ষা করা হয়েছে। এই গবেষণায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক মূল্য ওঠানামার প্রভাব বিশ্লেষণ করে বলা হয়, কয়লা এবং এলএনজির মূল্যবৃদ্ধি সমকালীনভাবে ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) ওপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। উভয়ই সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তোলে। জ্বালানির মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর কোনো উল্লেখযোগ্য সমকালীন প্রভাব নেই।

গবেষণায় ইম্পালস রেসপন্স ফাংশনের ফলাফল স্পষ্টভাবে দেখায় যে, জ্বালানি মূল্য পরিবর্তনের প্রতি এক স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন ধনাত্মক প্রভাব সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে এবং এটি নীতি গ্রহণের প্রক্রিয়াতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম। ভ্যারিয়েন্স ডিকম্পোজিশনের ফলাফল দেখায় যে, সব ধরনের জ্বালানি মূল্যের আকস্মিক পরিবর্তন প্রতিক্রিয়ায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। হিস্ট্রিকাল ডিকম্পোজিশন থেকে প্রমাণিত হয় যে, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট, ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারি, ২০২২ সালের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি সংকটে জ্বালানির মূল্য ওঠানামা ছিল সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক পরিবর্তনের প্রধান উৎস।

অন্যদিকে জোহানসেন কোইনটিগ্রেশন টেস্টের ফলাফল নির্দেশ করে যে, সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদি সময়কালে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচক এবং বিভিন্ন জ্বালানি মূল্যের মধ্যে একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। গবেষণার ফলাফলে সরকারি নীতিতে পরিবর্তন আনা, নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব শক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করা হয়।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ ও শক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের গুণমান এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির গতিবিধির মূল্যায়ন শিরোনামে দ্বিতীয় গবেষণাটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক মান এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির গতিশীলতা মূল্যায়ন করেছে।

গবেষণায় বলা হয়, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে দুর্বল সমন্বয় নীতিগত সামঞ্জস্যের অভাবে দীর্ঘমেয়াদে নীতির কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (স্রেডা) এর ক্ষমতা সীমিত এবং বিপিডিবির নবায়নযোগ্য জ্বালানি শাখা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাধান্য বিস্তার করায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীভূত বাজার কাঠামোর ফলে বিপিডিবি একক ক্রেতা হিসেবে কাজ করে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সীমিত হচ্ছে।

২০২৫ সালে এ জ্বালানি খাতের ভর্তুকির ৮০ শতাংশ (৩২,০০০ কোটি টাকা) ক্যাপাসিটি চার্জে বরাদ্দ, যা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর সুবিধা নিশ্চিত করেছে। কয়লা, গ্যাস, এলএনজি এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি সোলার প্রযুক্তির তুলনায় বেশি রেন্ট সিকিং এর সুযোগ দেয় এবং গত ১৪ বছরে ১ ট্রিলিয়ন টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদক (আইপিপি) এবং ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পেয়েছে। স্বচ্ছতার অভাবে প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ায় অপ্রতিযোগিতামূলক ও গোপনীয়তা ছিল, যা বিদ্যুৎ ক্রয় মূল্য এবং অকার্যকর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ন্যায্যতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। সর্বোপরি, দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাগ্রস্ত।

জরিপে দেখানো হয়, ৩৮.২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন বাংলাদেশে বর্তমান নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ও প্রণোদনা কার্যকর নয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় সৌরচালিত সেচ ব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে। সৌরশক্তিকে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও কার্যকর সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যা দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাস্তবসম্মত।

প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা এবং অংশীজনদের প্রভাবও এ জরিপে উঠে এসেছে। ৮৫.৩৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর উচ্চ সক্ষমতা রয়েছে।

অন্যদিকে ৪২.৪৮ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি কোম্পানিগুলোর এই উচ্চ সক্ষমতা রয়েছে। সরকারি সংস্থা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলো জ্বালানি নীতিমালা গঠনে সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবুও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা হয়েছে, যা শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব এবং আরও সুস্পষ্ট নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

জরিপের তথ্যে বলা হয় বাংলাদেশের ২০৪১ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য অর্জনকে অনেকেই শংকামিশ্রিত আশাবাদ নিয়ে দেখছেন। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেক ৪৫.৩৬ শতাংশ এই রূপান্তরকে সম্ভব বলে মনে করেন। তবে অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এবং বিনিয়োগ নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। ৪২.৫৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বেসরকারি বিনিয়োগের অভাবকে একটি বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জমির অভাবও বড় আকারের নবায়নযোগ্য প্রকল্প সম্প্রসারণকে সীমিত করছে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বের মতো লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব, যদি সঠিক কৌশলগত বিনিয়োগ, নীতি সংস্কার এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। চিহ্নিত বাধাগুলো দূর করে বাংলাদেশ পরিবেশগত সুবিধার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি টেকসই জ্বালানি নির্ভর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে।

বাংলাদেশে ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজনীয়তার মূল্যায়ন শিরোনামে তৃতীয় গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ক্ষমতা ১২১৯.২৪ মেগাওয়াট, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৪.১৬ শতাংশ। ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের প্রয়োজন।

প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব, গ্রিন বন্ড এবং বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে অর্থায়ন সুপারিশ করা হয়েছে।

পাশাপাশি, অনুদান, ঋণ এবং ইক্যুইটির মিশ্রণে একটি বিশেষায়িত নবায়নযোগ্য জ্বালানি তহবিল গঠিত হলে তা ছোটো ও মাঝারি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পগুলোকে সহায়তা করতে পারে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং কার্যকরি ব্যয় পরিচালনার জন্য কর প্রণোদনা এবং ঝুঁকি গ্যারান্টি সহায়ক নীতিমালা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেও উল্লেখ করা হয়।

এনএস/এমআইএইচএস/এএসএম

Read Entire Article