নভেম্বরে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ১৬, আহত ৫৯৯

18 hours ago 4

গত নভেম্বর মাসে সারা দেশে কমপক্ষে ১০৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এ সহিংসতায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫৯৯ জন। এ মাসে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে কমপক্ষে ৪৬টি মামলা হয়েছে, ৪৬ সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন, গণপিটুনির ২১টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন এবং আহত হয়েছেন ১৫ জন, ৩৬টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৩ জন এবং ১১০ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) নভেম্বর মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনাভিত্তিক এক মাসিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলামের স্বাক্ষরে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

সংগঠনটি বলছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে মানবাধিকার পরিস্থিতির কিছু বিষয়ে উন্নতি ঘটলেও সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক মামলা ও গ্রেপ্তার, সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ, শ্রমিক হত্যা, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি নির্যাতন ও হত্যা, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।

এইচআরএসএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে কমপক্ষে ১০৩টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫৯৯ জন। সহিংসতার ১০৩টি ঘটনার মধ্যে ৫১টি ঘটনা ঘটেছে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে, ২৩টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে, ৪টি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে, ২টি আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে, ৩টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অন্তর্কোন্দলে ও ২০টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। নিহত ১৬ জনের মধ্যে অন্তর্কোন্দলে বিএনপির ১০ জন ও আওয়ামী লীগের ২ জন নিহত হয়েছেন। বাকি ৪ জন নিহত হয়েছেন বিরোধী পক্ষের হামলায়। ১৬ জন নিহতের মধ্যে ১২ জন বিএনপির, ৩ জন আওয়ামী লীগের ও ১ জন ইউপিডিএফ কর্মী-সমর্থক। এছাড়াও সারা দেশে আধিপত্য বিস্তার ও দুর্বৃত্তের হামলায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতসহ আরও অন্তত ১১ রাজনৈতিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। এ মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ক্যাম্পাসে কমপক্ষে ৪টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১১ জন।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়, পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে কমপক্ষে ৪৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৩৭০৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৩৮৬৮ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা হলো ২৫৪টি। এর মধ্যে হত্যা মামলার সংখ্যা ২১৪টি। এ মাসে রাজনৈতিক মামলায় কমপক্ষে ৪৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী অন্তত ৪২৮ জন।

সেনাসদস্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার তথ্য তুলে ধরে এতে বলা হয়, চট্টগ্রামের মিয়া শপিং কমপ্লেক্সে ও মোল্লা স্টোরের ওসমান গনি নামে একজন ব্যবসায়ীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ইসকনবিরোধী একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ এবং পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে ইটপাটকেল ও এসিড নিক্ষেপে সেনাসদস্য এবং ৭ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর যৌথবাহিনীর অভিযানে ৮২ জনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়াও পাবনার চাটমোহর ও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কটূক্তির জেরে ২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন ও হয়রানির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ মাসে অন্তত ২৭টি ঘটনায় কমপক্ষে ৪৬ সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্ততপক্ষে ১৭ জন, লাঞ্চনার শিকার হয়েছেন ৯ জন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ৩ জন ও গ্রেপ্তার হয়েছেন ৫ জন। এছাড়াও ৩টি মামলায় ১৩ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এটি উদ্বেগজনক যে, দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা বন্ধের দাবিতে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভ মিছিল, হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

সীমান্তে হামলা, আহত-নিহত ও আটকদের তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, নভেম্বর মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক ৩টি হামলার ঘটনায় ৪ জন আহত ও ৩৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) কর্তৃক ৫টি হামলার ঘটনায় ১ জন বাংলাদেশি নিহত, ১ জন আহত ও ২৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার বিষয়ে বলা হয়, এ মাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর কমপক্ষে ৪টি হামলার ঘটনায় ১টি মন্দিরে হামলা ও ৩টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিকে ঘিরে চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে এক আইনজীবী নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৫ জন। এছাড়া শেরপুরের খাজা বদরুদ্দোজা হায়দার ওরফে দোজা পীরের অনুসারীদের সাথে পীরবিরোধী পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় পীরবিরোধী আহত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৩ জন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পীরবিরোধী পক্ষ দোজা পীরের দরবারে (মুর্শিদপুর পীরের দরবার) ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।

গণপিটুনির তথ্য উল্লেখ করে এতে বলা হয়, এ মাসে গণপিটুনির কমপক্ষে ২১টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন এবং আহত হয়েছেন ১৫ জন। উল্লেখ্য, খুলনায় সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের ভাগনে শেখ আরিফুজ্জামান রূপম (৩৪) গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। এ মাসে সারা দেশে কারাগারে কমপক্ষে ৫ জন আসামি মারা গিয়েছেন, যাদের মধ্যে ১ জন কয়েদি ও ৪ জন হাজতি রয়েছেন।

শ্রমিক নির্যাতনের বিষয়ে বলা হয়, নভেম্বর মাসে ৩৬টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৬ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৩ জন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং শ্রমিকদের সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবে দুর্ঘটনায় ১০ শ্রমিক তাদের কর্মক্ষেত্রে মারা গেছেন। এ মাসে বকেয়া বেতনের দাবিতে বেশ কয়েকবার মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা।

নারী ও শিশু নির্যাতনের তথ্য উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, নভেম্বর মাসে কমপক্ষে ১১০ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩২ জন, যাদের মধ্যে ১৭ (৫৩ শতাংশ) জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, ৭ নারী ও কন্যাশিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে। ২৪ নারী ও কন্যাশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তন্মধ্যে শিশু ১২ জন। এ ছাড়া যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ২ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ জন। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৩১ জন, আহত হয়েছেন ৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১৫ নারী। এসিড সহিংসতার শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ১ নারী ও ১ কন্যাশিশু। অন্যদিকে, এটি উদ্বেগজনক যে, ১০৪ শিশু নির্যতানের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৪৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৫৭ শিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

সার্বিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সুপারিশ করে প্রতিবেদনে সংগঠনটি বলছে, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়ন করা জরুরি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর এসব বিষয় বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। তাই ‘এইচআরএসএস’র পক্ষ থেকে সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় ও সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে এবং দেশের সব সচেতন নাগরিক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতা ও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে আরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।

Read Entire Article