নারায়ণগঞ্জে দুই হাজার মানুষের নিরাপত্তায় একজন পুলিশ

6 hours ago 1

নারায়ণগঞ্জের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় জনসাধারণের নিরাপত্তায় বাড়ছে না পুলিশের জনবল। ফলে দিনদিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই নারায়ণগঞ্জের কোনো না কোনো এলাকায় হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জেলায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮৬ জন। হত্যার পাশাপাশি বেড়েছে চুরি, ছিনতাই, মাদক ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ। জেলায় কর্মরত একজন পুলিশ সদস্যের ওপর দায়িত্ব পড়ছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষের।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের ৮ তারিখ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মোট ৮৬টি। একই সময়ে চুরি হয়েছে ৯৭টি, ছিনতাই ৩৪টি, ডাকাতি ১৯টি। এ ছাড়া ৭৬১টি মাদক মামলা এবং নারী নির্যাতন আইনে ২০৩টি মামলা করা হয়েছে।

এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য মতে সর্বশেষ ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জের জনসংখ্যা ছিল ৩৯ লাখ ৯ হাজার ১৩৮ জন। বিগত সময়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ ১১ হাজার। পরিসংখ্যান অফিসের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক সাঈদ আহমেদ এসব তথ্য জানান।

ফলে হিসেব অনুযায়ী জেলায় প্রতি ২১৪৬ জন মানুষের নিরাপত্তায় একজন পুলিশ রয়েছেন। এতে পুলিশের পক্ষে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শুরু করে শহরাঞ্চল সর্বত্র নজরদারিতে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, সম্প্রতি জেলায় একের পর এক হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ ঘটছে। সর্বশেষ গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের ইসদাইর এলাকার হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি কিশোর গ্যাং প্রধান ইভনকে (৩০) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইভন ফতুল্লা ইসদাইর এলাকার সাইফুল ইসলামের ছেলে। সাইফুল, শফিকুল ও বাবু নামের এ তিন সহোদরের হাত পায়ের রগ কেটে দেওয়ার জের ধরে এই ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।

ইভনের বাবা বাবু ওরফে জামাই বাবু জানিয়েছেন, রাত সাড়ে ৮টায় তিনি খবর পান ইভনকে কুপিয়ে জখম করা হয়েছে। তিন ভাই মিলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইভন মারা যায়।

এর আগে গত ১৮ জানুয়ারি আড়াইহাজারের কালাপাহাড়িয়া ইউনিয়নের রাধানগর এলাকায় জমি সংক্রান্ত বিরোধে মিলন মিয়া (৫০) নামে এক ট্রলার চালককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রূপগঞ্জের তারাবো পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরান বাজার এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও মাদক নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ছুরিকাঘাতে ২ যুবকের মৃত্যু হয়।

গত ৩১ মার্চ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় পঞ্চবটি-মুক্তারপুর রোডের কাশিপুর এলাকায় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে পাভেল (৩৯) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত ১১ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পশ্চিমপাড়া এলাকা থেকে দুই নারী ও এক শিশুর খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৪ জুন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার উত্তর নরসিংহপুর এলাকায় মাদক ব্যবসার পাওনা টাকা না পেয়ে স্বপন মোল্লা (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে মাদক কারবারিরা।

গত ৪ জুলাই আড়াইহাজারের পূর্বপাড়া এলাকায় বাবাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠেছে ছেলের বিরুদ্ধে। হত্যার শিকার মো. মাহবুব (৪২) কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত ছেলে মো. ইয়াসিন (২২) পলাতক রয়েছেন।

গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বন্দরে কুড়িপাড়া স্কুলমাঠ সংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদী থেকে এক মস্তকবিহীন যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত যুবকের নাম হাবিবুর (২৮)। তিনি সোনারগাঁ থানার কাঁচপুর মধ্যপাড়া এলাকার মো. চান মিয়ার ছেলে। মাদক সংক্রান্ত বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটে।

অন্যদিকে নানা ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংঘাতেও অনেক প্রাণ হারাচ্ছেন। এর মধ্যে গত ১৯ মার্চ রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে যুবদল-স্বেচ্ছাসেবক দলের সংঘর্ষে হাসিব (২৮) নামে একজন নিহত হয়েছে। গত ১০ জুন রূপগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে নিতে ছাত্রদল নেতার গুলিতে প্রাণ হারান মামুন হোসেন (৩৫) নামে এক ব্যবসায়ী। একই মাসে বন্দর উপজেলায় বিএনপির দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে আব্দুল কুদ্দুস (৫৫) ও মেহেদী হাসান (৪২) নামে দুইজনের মৃত্যু হয়। সবশেষ জুলাই মাসে আড়াইহাজারে বিএনপির অফিস ভাড়া চাওয়াকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীর হোসেন (৫৭) নামে এক দোকান মালিক ও মৎস্যজীবী দলের নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিমের জনবল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। জনবল সংকটের পাশাপাশি পুলিশের রয়েছে পরিবহন সংকট। গত বছরের ৫ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ ও আড়াইহাজার থানায় হামলার ঘটনায় বিপুলসংখ্যক অস্ত্র লুটের পাশাপাশি পুলিশের একাধিক যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

আন্দোলনের সময়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও কিছু যানবাহন। এখন পর্যন্ত পরিবহনের ঘাটতি কাটেনি। জেলা পুলিশের জন্য বর্তমানে অন্তত ৬টি ডাবল কেবিন পিকআপ ও ট্রাফিক বিভাগের জন্য ২০টি মোটরসাইকেল জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অপারেশন) তারেক আল মেহেদী বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগের প্রেক্ষাপট আর বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়। সামগ্রিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে। ফলে অপরাধ কিছুটা বেড়েছে। তারপরও আমরা কঠোর নজরদারিতে পুরো জেলাকে রেখেছি। মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় আমরা বদ্ধপরিকর।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, নারায়ণগঞ্জ একটা জনবহুল এলাকা। এখানে বিভিন্ন জেলার মানুষ বসবাস করে থাকে। যার কারণে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কিছুটা বেগ পোহাতে হয়। তবে যে কোনো ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা অ্যাকশন নিয়ে থাকি।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জনবল আরও প্রয়োজন। এই জনবল নিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখাটা বেশ কঠিন। পাশাপাশি পরিবহনের কিছুটা সংকট রয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কথা বলেছি। তারপরও আমাদের পুলিশ বাহিনী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

এমএন/জিকেএস

Read Entire Article