নিরাপদ মাতৃত্বে পরিবার, সমাজ ও সরকারের দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ

3 months ago 7

‘মা ও শিশুর সুস্থতা একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের মূলভিত্তি।’ বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস প্রতি বছর ২৮ মে তারিখে পালন করা হয়। যা মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষা, প্রসবকালীন জটিলতা রোধ এবং নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এই দিনটি শুধু চিকিৎসাগত সেবাই নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমর্থনেরও কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিরাপদ মাতৃত্বের গুরুত্ব, বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং স্বাস্থ্য পরামর্শ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. শায়লা হক (মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও হেলথ প্রেজেন্টার)। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম-

জাগো নিউজ: বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের মূল উদ্দেশ্য কী বলে আপনি মনে করেন?
ডা. শায়লা হক: এই দিনটির মূল উদ্দেশ্য, গর্ভকালীন সময়ে মায়ের সঠিক যত্ন, মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং কোনো জটিলতা যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশে গর্ভাবস্থা ও প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণগুলো কী?
ডা. শায়লা হক: দেশে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ, ২০ বছরের নিচে সন্তান নেওয়া। এছাড়া প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, বিলম্বিত প্রসব, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা, পারিবারিক অবহেলা ও ঠিকমতো প্রসব করতে না পারায় ইনফেকশন হয়। অন্যদিকে কম ওজন নিয়ে জন্ম, প্রি-ম্যাচিউর, জন্মের পরপর শ্বাস না নেওয়া ও নাভিতে ইনফেকশনের কারণে নবজাতকের মৃত্যু হয়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গর্ভকালীন সময়ে শতকরা ১৫ জন নারী নানা রকম জটিলতায় ভোগেন এবং শতকরা প্রায় ৫১ জন নারী রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনির কারণে মৃত্যুবরণ করে।

জাগো নিউজ: বর্তমানে বাংলাদেশে মাতৃস্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন? শহর ও গ্রামে গর্ভবতী নারীদের সেবার মধ্যে কী ধরনের বৈষম্য আপনি লক্ষ্য করেন?
ডা. শায়লা হক: বর্তমানে বাংলাদেশে মাতৃকালীন সেবায় দেশের বহু সংখ্যক নারী এখনো অধিকার ও সেবা থেকে বঞ্চিত। অসংখ্য পরিবার আছে যাদের কাছে এ ধরনের সেবা পৌঁছায় না, বিশেষ করে গ্রামে। আবার অসংখ্য পরিবারকে দেখা যায়, যারা সামাজিক সমস্যা, বিভ্রান্তি, ও অজ্ঞতার কারণে চিকিৎসা সেবা নিতে আগ্রহী হয় না। আমরা এখনো বিপরীতমুখী দুটি আলাদা স্রোতের মুখোমুখি হতে দেখি। কিন্তু শহরে আমরা তুলনামুলক এই সেবা প্রায় সবার কাছে সচেতনভাবে পৌঁছাতে পারছি। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা এবং চিকিৎসা সেবাও নিশ্চিত করা যাচ্ছে।

জাগো নিউজ: নিরাপদ মাতৃত্বে সবচেয়ে বড় বাধা কী? কোন ধরনের কুসংস্কার বা ভুল ধারণা এখনো দেখা যায়?
ডা. শায়লা হক: নিরাপদ মাতৃত্বে বড় বাধা গর্ভকালীন জটিলতা, দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা দানকারীর অনুপস্থিতি, প্রয়োজনীয় যত্নের অভাব, পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে। এসব বিষয়গুলোতে পরিবারের অসচেতনতা, প্রসব-পরবর্তী সেবাযত্নের অভাবে একজন মাকে ঠেলে দিচ্ছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ আর কষ্টের মাঝে। এখনো আমাদের মাঝে বিশেষ করে গ্রামে আর তথাকথিত বয়োজ্যেষ্ঠদের মাঝে কিছু কুসংস্কার দেখা যায়। যেমন-শুয়ে বসে থাকা যাবে না, কাজ না করলে পেট বড় হয়ে যাবে, বেশি খেলে বাচ্চা বড় হয়ে যাবে; তখন বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি হবে না। ডাক্তার দেখালে সিজার করেই বাচ্চা বের করতে হবে-এইসব কথাগুলো ভেসে বেড়ায়। গ্রামীণ গর্ভবতী মায়েদের এসব কথায় কর্ণপাত না করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

জাগো নিউজ: গর্ভবতী নারীর পরিবার, বিশেষ করে স্বামীর কী ভূমিকা থাকা উচিত?
ডা. শায়লা হক: গর্ভবতী নারীর যত্নে তার পরিবার বিশেষ করে তার স্বামীর ভূমিকা অনেক। স্বামী হিসেবে তার এ সময়ে স্ত্রীকে সহায়তা করা দরকার। তাকে উৎসাহিত করুন, তার পাশে দাঁড়ান এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করান। গর্ভাবস্থায় স্ত্রীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা স্বামী হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, তার পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করা, প্রসবোত্তর সময়কালে মাকে সহায়তা করা। পাশাপাশি গৃহস্থালির কাজ এবং রান্নার খাবারে সাহায্য করুন। সন্তান প্রসবের পর মায়েদের বিশ্রাম এবং পুনরুদ্ধারের জন্য সময় প্রয়োজন।

জাগো নিউজ: নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সরকার, সমাজ বা পরিবারকে কী কী করতে হবে?
ডা. শায়লা হক: আমাদের সরকার, সমাজ ও পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে। সেক্ষেত্রে আমরা যাতে যথা সময়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারি সেই লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকার করতে হবে। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে আমাদের চাওয়া সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়বে, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হবে এবং সব শ্রেণির মানুষ এই অধিকার পাবে। গর্ভবতী মায়েদের কোনো অসুখ থাকলে তা নির্ণয় করা এবং তার চিকিৎসা করা, মা যাতে গর্ভকালীন সময়ে নিজের যত্ন নিতে পারেন। আসন্ন প্রসবের জন্য নিজেকে তৈরি হতে হবে এবং নবজাতক শিশুর যত্ন নিতে পারেন। আমাদের কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন- গর্ভাবস্থায় জটিল উপসর্গগুলো নির্ণয় করা, নিরাপদ প্রসব বাড়িতে না স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোথায় সম্ভব হবে তা নির্বাচন করা, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মীর ব্যবস্থা করা, সব গর্ভবতী মায়ের রেজিষ্ট্রেশন করা।

জাগো নিউজ: গর্ভবতী মায়েদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?
ডা. শায়লা হক: গর্ভবতী মায়েদের জন্য আমার পরামর্শ থাকবে পুরো গর্ভাবস্থার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার এবং নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। যতক্ষণ আপনি এটি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, ততক্ষণই আপনার দৈনিক শারীরিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন। সুষম খাদ্যতালিকা দরকার, এতে করে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত ও খাদ্যঘাটতি দূর করা সম্ভব। এ সময় প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ খেতে হবে। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে মৌসুমি ফল ও শাক-সবজি খেতে হবে। গর্ভকালীন সময়ে অর্থাৎ ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়া থেকে শুরু করে ৯ মাস ৭ দিন ব্যাপী মাঝখানে গর্ভবতী মা নিয়মিত পরীক্ষা এবং ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে যাওয়া, গর্ভকালীন সময়ে কমপক্ষে ৪ বার পরীক্ষা করা প্রয়োজন।

জাগো নিউজ: তরুণ প্রজন্ম বা স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আপনার বার্তা কী?
ডা. শায়লা হক: তরুণ প্রজন্ম আর স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আমার বার্তা হচ্ছে, স্বাস্থ্য সেবার গুণগত মান বৃদ্ধিতে চেষ্টা করা। তার সম্পর্কে মা, পরিবার ও সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, মা ও শিশুমৃত্যু রোধ এবং তাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করা। আমাদের উচিৎ মাতৃমৃত্যু নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করা। এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা এবং বাল্যবিয়ে রোধ করা। তবেই মাতৃমৃত্যু হার কমানো সম্ভব। আশা করি তরুণ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর বিভিন্ন উপায়ে এই বিষয়গুলোতে সোচ্চার ও সচেতনতা তৈরি করতে সহায়তা করবে।

কেএসকে/এএসএম

Read Entire Article