নির্বাচন-পূর্ব অর্থনীতিতে ৪ ঝুঁকি, সংকটের আড়ালে সম্ভাবনার হাতছানি

রোডম্যাপ ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি একাধিক চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। রপ্তানি-রেমিট্যান্সসহ অর্থনীতির কয়েকটি সূচক বেশ ইতিবাচক হলেও এখনো সংকটে অর্থনীতি। কিছু ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় থাকলেও মূল্যস্ফীতির উচ্চহার, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত না হওয়া এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে মন্দাসহ চার ঝুঁকিতে দেশের অর্থনীতি।   চাপে থাকা অর্থনীতির মধ্যেও সরকার সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতি কষাঘাত থেকে স্বস্তি দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো সহনীয় পর্যায়ে নামেনি মূল্যস্ফীতি। সব ধরনের চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও ডিমের দাম এখনো বাড়তি। পেঁয়াজের দর নতুন করে সেঞ্চুরি হাঁকানোয় আরেক দফা চাপে পড়েছেন ভোক্তারা। সেপ্টেম্বরে তুলনায় অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। সেপ্টেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩৬। সেটা অক্টোবরে কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৭। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তি। সার্বিক মূল

নির্বাচন-পূর্ব অর্থনীতিতে ৪ ঝুঁকি, সংকটের আড়ালে সম্ভাবনার হাতছানি

রোডম্যাপ ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি একাধিক চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। রপ্তানি-রেমিট্যান্সসহ অর্থনীতির কয়েকটি সূচক বেশ ইতিবাচক হলেও এখনো সংকটে অর্থনীতি। কিছু ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় থাকলেও মূল্যস্ফীতির উচ্চহার, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত না হওয়া এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে মন্দাসহ চার ঝুঁকিতে দেশের অর্থনীতি।  

চাপে থাকা অর্থনীতির মধ্যেও সরকার সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতি কষাঘাত থেকে স্বস্তি দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো সহনীয় পর্যায়ে নামেনি মূল্যস্ফীতি। সব ধরনের চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও ডিমের দাম এখনো বাড়তি। পেঁয়াজের দর নতুন করে সেঞ্চুরি হাঁকানোয় আরেক দফা চাপে পড়েছেন ভোক্তারা। সেপ্টেম্বরে তুলনায় অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। সেপ্টেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩৬। সেটা অক্টোবরে কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৭। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়তি। সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কম মনে হলেও এখনো সহনীয় পর্যায়ে নামেনি, যা অর্থনীতিতে, বিশেষ করে সাধারণ ভোক্তাদের মাঝে অস্বস্তির অন্যতম কারণ। সরকার টিসিবির মাধ্যমে ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় প্রায় আড়াই কোটি অসচ্ছল মানুষকে ভর্তুকি মূল্যে চাল বিক্রিসহ বিভিন্নভাবে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা সবার মুখে হাসি ফোটাতে পারছে না। 

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক হলেও এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বাড়েনি। ৯ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (আকু) বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ আবার কমেছে। রোববার রিজার্ভ থেকে আকুর বিল বাবদ ১৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করা হয়। এরপর মোট রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, ১০ নভেম্বর রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে ৪ মাসের আমদানি চাহিদা মেটানো গেলেও রিজার্ভের এ অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত নয় বলছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তবে, সুখকর খবর হলো এখনো ইতিবাচক দেশের রপ্তানি। তৈরি পোশাক শিল্পনির্ভর এ রপ্তানি খাতটি দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা ধীর হলেও প্রবৃদ্ধি এখনো আশা জাগানিয়া। ট্রাম্পের ঘোষণা করা ট্যারিফের কারণে ভারত তার রপ্তানিতে বড় হোঁচট খেলেও সুবিধাজনক অবস্থানে বাংলাদেশ। রপ্তানি খাত বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের পরে স্থিতিশীলতা ফিরলে রপ্তানি আরেকদফা বাড়তে পারে। চীনের হারানো বাজারও আসতে পারে বাংলাদেশের কাছে। 
দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে হতাশার জায়গা নতুন কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ। দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগই এখনো স্থবির। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় হাত গুটিয়ে রেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রোডশো এবং বিদেশিদের দেশে এনে সভা-সেমিনার করা হলেও বিদেশি বিনিয়োগে এখনো ভাটার টান। কোভিডের অর্থবছর বাদ দিলে দেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমেছে গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে। বিনিয়োগও এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব সন্ত্রাসের মতো ঘটনায় বেসরকারি খাত এখনো আস্থাহীন। অর্থনীতির গতি মন্থর বা শ্লথ হয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। নতুন বিনিয়োগ না বাড়ায় কর্মসংস্থানেও গতি ফিরছে না। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। ২০২৪ সালে দেশে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে ৩.৬৬ শতাংশে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সর্বশেষ পরিস্থিতি এখন খুবই উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২১.২% হয়েছে। সেই ধারায় কর্মসংস্থানও কমেছে ব্যাপকভাবে। পুরুষদের তুলনায় নারী কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার এখন প্রায় ১২ শতাংশের কাছাকাছি। বেকারত্বের বিপরীতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া চরম ঝুঁকি তৈরি করেছে অর্থনীতিতে। বেকারত্ব বৃদ্ধির এ হারকে ‘জরুরি অবস্থা’র সাথে তুলনা করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। 

ব্যাংক খাতের বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ কুরে কুরে খাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। দেশে সর্বশেষ জুন মাসের তথ্যে দেখা যায়, খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। সংকট কাটাতে সরকার আইএমএফের সাথে ঋণচুক্তি করেছে। বাজেট ঘাটতি পূরণে কর বৃদ্ধি এবং জ্বালানির দাম সমন্বয় করেছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। দুর্বল ৫ ব্যাংককে একীভূত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া উদ্যোগও এখনো সফলতার মুখ দেখেনি। 

সার্বিক বিষয় বিবেচনায় এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভের ঘাটতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং বেকারত্ব অর্থনীতির জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ খাত। এ অবস্থায় প্রায় সবকিছু নির্ভর করছে আগামী নির্বাচিত সরকারের ওপর। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও সম্প্রতি স্বীকার করেছেন, আইএমএফের দেওয়া ঋণের ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে যেসব সংস্কারে সরকার হাত দিয়েছে তা পরবর্তী নির্বাচিত সরকার কতটা গুরুত্ব দেয় তার ওপরই নির্ভর করবে আইএমএফের পরবর্তী কিস্তি। তবে, যেসব সংস্কার তারা করেছেন তা পরবর্তী সরকারের হাতে প্যাকেজ আকারে দিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। একই কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যে পে-স্কেল/পে-কমিশন করার কথা ছিল সে ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। সবকিছু চূড়ান্ত করে দিলেও তা পরবর্তী সরকারের জন্য রেখে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।  

আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি এখন যেসব চ্যালেঞ্জ ও চাপ বিরাজ করছে তা দূর করতে হলে সংস্কার ও নীতির ধারাবাহিকতা জরুরি। বিশেষ করে নির্বাচনের পরও যাতে আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় থাকে এবং সংস্কারমূলক কাজগুলো সমান তালে এগিয়ে নেওয়া যায়, তাহলেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। স্বস্তি ফিরবে অর্থনীতিতে। আর তাই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সবার দৃষ্টি এখন জাতীয় নির্বাচনের দিকে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow