নিষ্ঠুর খুন ও প্রতিশোধ, সমাজের অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি

4 hours ago 7

২০২৫ সালের ৯ জুলাই, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে মাটিতে পড়ে থাকা দেহকে ঘিরে আছে কিছু লোক। কয়েকজন একের পর বড় আকৃতির পাথর ছুড়ে মারছে ওই দেহে। পিটিয়ে, ইট-পাথর ছুড়ে সেখানে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ৩৯ বছর বয়সী ভাঙারি ব্যবসায়ী মো. সোহাগ ওরফে লাল চাঁদকে। হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, হত্যার পর বুকের ওপর দাঁড়িয়ে করা হয় বুনো উল্লাস। এমন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড পুরো জাতিকে স্তম্ভিত করেছে।

একইভাবে গত ৭ আগস্ট গাজীপুরে অস্ত্রধারী একটি দলের সহিংসতার ভিডিও করায় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলাকেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ সোমবার (১০ নভেম্বর) প্রায় ২৯ বছর আগের একটি হত্যা মামলায় ঢাকার আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে খুন হন তারিক সাইফ মামুন (৫৫)। আদালতপাড়ার কাছে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় তাকে। হাসপাতালের প্রবেশমুখে হঠাৎ দুই দুর্বৃত্ত তার পেছনে এসে খুব কাছ থেকে একাধিক গুলি চালান। গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর হামলাকারীরা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

এভাবে দেশে একের পর এক সংহিংস হত্যাকাণ্ড, গণপিটুনি, রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও পারিবারিক সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ। রাজনীতি থেকে শুরু করে পারিবারিক দ্বন্দ্ব—সবখানেই ছড়িয়ে পড়ছে হিংস্রতা ও প্রতিশোধের সংস্কৃতি। মানবিক মূল্যবোধ যেন হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে।

আরও পড়ুন
ব্যবসায়ীদের কড়া বার্তা দিতেই সোহাগকে হত্যা করে বুনো উল্লাস
মোটরসাইকেল থেকে নেমেই গুলি ছোড়েন দুজন, ছিলেন মাস্ক-ক্যাপ পরা
২৯ বছর আগের হত্যা মামলার হাজিরা দিতে এসেই খুন হলেন মামুন

মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানিয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৮১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ছয় হাজার ৬৯৮ জন। গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৫৩ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যা ৪০ এবং কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৮৮ জনের।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে সহিংসতার মূল কারণ দুর্বল আইনের শাসন ও বিচারহীনতা। অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। রয়েছে সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের সংকট। সহমর্মিতা, যত্ন এবং আস্থা হ্রাস পেয়েছে। সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ হচ্ছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সহিংসতা বৈধতা পাচ্ছে।

সহিংসতা প্রতিরোধে মনস্বাস্থ্য সেবা সম্প্রসারণ; দ্রুত ও কার্যকর বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহমর্মিতা ও নৈতিক চর্চা পুনর্গঠন; সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম, কমিউনিটি এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সহিংসতা উসকানিমূলক বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ ও জনসচেতনতার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহানা পারভীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষের এই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠার পেছনে আসলে একাধিক কারণ কাজ করে। প্রাচীনকালেও টিকে থাকার লড়াইয়ে মানুষ হিংস্র ছিল। কিন্তু এখন প্রতিশোধ আর ক্ষমতার প্রকাশ যেন সামাজিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। খুবই তুচ্ছ কারণেও মানুষ অন্যকে হত্যা করছে—কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিত্বের ধরন এখানে বড় ভূমিকা রাখে। কিছু মানুষ খুবই ইম্পালসিভ (আবেগপ্রবণ), সহনশীলতা কম, হিংসাত্মক প্রবণতা বেশি। আবার অনেকের শৈশবের ট্রমা বা নির্যাতনের অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে প্রতিশোধমূলক আচরণ বাড়িয়ে দেয়। কেউ যদি ছোটবেলায় সহিংসতা, নির্যাতন বা হত্যার দৃশ্য দেখে বড় হয়—তার মনে নিষ্ঠুরতা সহজেই গেঁথে যায়।’

ডা. শাহানা পারভীন আরও বলেন, ‘আমাদের সমাজে এখন সহিংসতাকে গ্লোরিফাই (মহিমান্বিত) করা হচ্ছে। সিনেমা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা বাস্তব রাজনীতিতেও দেখা যায়—খুনি বা অপরাধী অনেক সময় নায়ক হয়ে যাচ্ছে, ফুল দিয়ে বরণ করা হচ্ছে। এতে অন্যদের মধ্যেও সেই ক্ষমতার নেশা কাজ করে।’

আরও পড়ুন
চাঁদাবাজি নয়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে খুন হন সোহাগ: পুলিশ
গাজীপুরে প্রকাশ্যে সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা
পুলিশ শটগান দিয়ে কাছ থেকে আবু সাঈদকে গুলি করে

তিনি বলেন, অনেকে আবার আত্মবিশ্বাসহীনতা বা হীনমন্যতা কাটাতে অন্যকে দমন করে, নির্যাতন করে এক ধরনের মানসিক তৃপ্তি পায়। খুনের পরও যখন কেউ লাশ বিকৃত করে, তখন সেটা তার ‘আত্মতৃপ্তি’ বা ‘ক্ষমতার অনুভূতি’ থেকে আসে। নিজের অক্ষমতাকে ঢাকতে সে নিষ্ঠুরতাকে প্রকাশ করে।

মনোবিজ্ঞানী ডা. শাহানা মনে করেন, সহিংসতা রোধে কেবল আইন নয়—মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, নৈতিক শিক্ষা ও পরিবারভিত্তিক সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে এই নিষ্ঠুরতা সমাজের গভীরে আরও শেকড় গেড়ে বসবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ড, গণপিটুনি এবং অন্যান্য সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত রাগ বা প্রতিশোধের ফল নয়। এগুলো আমাদের সমাজব্যবস্থার গভীর অসুস্থতার প্রতিফলন। আইনের শাসন দুর্বল, বিচার বিলম্বিত এবং ভঙ্গুর সামাজিক সংহতি—এই পরিবেশই অপরাধীদের উৎসাহিত করছে।

তিনি বলেন, যখন কেউ অপরাধ করে পার পেয়ে যায় বা বিচার বিলম্বিত হয়, তখন অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি মনে করে প্রতিশোধ নেওয়া বা সহিংসতা ঘটানো তার ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম। বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতা ও আইনের কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এ ধরনের অপরাধ ক্রমবর্ধমান হচ্ছে।

ড. তৌহিদুল হক আরও বলেন, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের সংকটও অপরাধপ্রবণতা বাড়াচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী, অভিভাবক-সন্তান বা প্রতিবেশী—কেউই নিরাপদ নয়। আস্থা ও সংহতির অভাব অপরাধীদের আরও সাহসী করে তোলে। সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য হলো সম্প্রীতি এবং মানুষের মধ্যে আস্থা; কিন্তু তা ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এ ধরনের পরিবেশে অপরাধী তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ, প্রতিশোধ এবং ক্ষমতার দম্ভকে বাস্তবায়ন করতে পারে। এমন পরিস্থিতি শুধু আইনের মাধ্যমে নয়, সামাজিক সচেতনতা, নৈতিক শিক্ষা এবং পরিবারের সহমর্মিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আরও পড়ুন
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে ৭ মাসে ১৭৩৮ মামলা, বেড়েছে খুন
জুলাই হত্যাকাণ্ডের দায় নেবেন না হাসিনা: ইন্ডিপেনডেন্ট
হাজী সেলিমের ভাতিজার ছত্রছায়ায় চোরাই তারের ব্যবসা করতেন সোহাগ

মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট বাংলাদেশ’র কান্ট্রি লিড মনিরা রহমান বলেন, ‘নিষ্ঠুরতা একদিনে জন্মায় না। যখন সমাজে অপরাধের বিচার হয় না এবং সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি হয় না, তখন মানুষ ধীরে ধীরে এটিকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়। আমরা দেখছি, নৃশংস কাজগুলোকে সামাজিকভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের খারাপ লাগে, কিন্তু বড় পরিসরে আমরা নীরব।’

তিনি বলেন, সামাজিক সহমর্মিতা, সহনশীলতা এবং মানুষের প্রতি যত্ন ও ভালোবাসা তৈরির জন্য চর্চা প্রয়োজন। কিন্তু যদি চর্চা না থাকে, বরং অপচর্চা, হিংসা এবং বিদ্বেষ বেড়ে যায়, তাহলে সহিংস আচরণ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সমাজ মনোবিজ্ঞানীরা এটিকে একটি ‘প্যান্ডেমিক পর্যায়ের হিংস্রতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

মনিরা রহমান আরও বলেন, ২০২৪ সালের সহিংসতার ধারাবাহিকতা দেখাচ্ছে, সামাজিক প্রতিরোধ ও নৈতিক প্রতিবাদ খুব দুর্বল। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাত্ম হতে পারছি না, বরং নীরবভাবে তা মেনে নিচ্ছি। এই নীরব গ্রহণই অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিদের সাহস বাড়াচ্ছে। ফলে নিষ্ঠুরতা ক্রমশ সমাজে নরমালাইজ হচ্ছে।

‘এই প্রক্রিয়াকে শুধু আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। পরিবার, স্কুল, কমিউনিটি এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহমর্মিতা, নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধ চর্চায় ফিরে আনতে হবে। নইলে এ ধরনের সহিংসতা সমাজের গভীরে আরও শেকড় গেঁথে বসবে।’ যোগ করেন মনিরা রহমান।

প্রতিদিন কেউ না কেউ সহিংসতার শিকার হয়ে হারাচ্ছেন প্রাণ। শান্তি ও মানবিকতার সমাজ গড়তে হলে প্রয়োজন আইনের শাসনের পাশাপাশি সহানুভূতির পুনর্জাগরণ। যতদিন মানুষ নিজের রাগ, ঘৃণা ও প্রতিশোধের আগুনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারবে, ততদিন সহিংসতার এই চক্র থামবে না—এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এসইউজে/ইএ/এমএমএআর/জিকেএস

Read Entire Article