রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে বৈষম্য দূর করতে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে ‘রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালা-২০২৫’ খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত এই নীতিমালা ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, নতুন নিয়মে উল্টো বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষত দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ে কাজ করা কর্মকর্তারা বঞ্চিত হতে পারেন, আর তুলনামূলক কম অভিজ্ঞ বা জুনিয়র কর্মকর্তারা দ্রুত উচ্চপদে চলে আসতে পারেন। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের নীতিমালাকে সময়োপযোগী করতে এই নতুন নীতিমালা প্রণয়ন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও মহাব্যবস্থাপকের (জিএম) নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে প্রযোজ্য হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি ও সিইও পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হবে। এ নিয়োগের জন্য বিবেচনায় আসবেন বর্তমান বা অবসরপ্রাপ্ত এমডি ও ডিএমডিরা। চুক্তির মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ তিন বছর।
যোগ্যতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রার্থীর ন্যূনতম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। তবে অর্থনীতি, হিসাববিজ্ঞান, ফাইন্যান্স, ব্যাংকিং, ব্যবস্থাপনা বা ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। শিক্ষাজীবনের কোনো পর্যায়ে তৃতীয় বিভাগ থাকলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৩ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে ২.৫০ বা ৫-এর মধ্যে ৩ থাকতে হবে। বিদেশি ডিগ্রি থাকলে তা সমমান নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া প্রার্থীর কর্মজীবনে সততা, সুনাম ও সাফল্যের প্রমাণ থাকতে হবে।
এমডি হওয়ার জন্য আরও শর্ত রাখা হয়েছে—ডিএমডি পদে ন্যূনতম দুই বছরের অভিজ্ঞতা এবং ৯ম গ্রেড থেকে কমপক্ষে ২০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা।
তবে সমালোচকরা বলছেন, অভিজ্ঞতার এই শর্ত অস্পষ্ট। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা মনে করেন, শুধু ২০ বছরের কর্মকাল যথেষ্ট নয়; বরং শাখা, কর্পোরেট শাখা, জেলা–বিভাগীয় কার্যালয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থায়ন, ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবেই যোগ্য নির্বাহী নির্বাচন নিশ্চিত হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিএমডি হিসেবে ন্যূনতম দুই বছরের অভিজ্ঞতার শর্ত নতুন বৈষম্য সৃষ্টি করবে। অতীতে পদোন্নতি নীতিমালার কারণে একেক ব্যাংকের কর্মকর্তারা দ্রুত উন্নীত হয়েছেন, আবার অনেকে পিছিয়ে পড়েছেন। ফলে সিনিয়র–জুনিয়রের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাদের পরামর্শ, ডিএমডি পদে চাকরির মেয়াদ নয়, বরং মোট কর্মকালকে গুরুত্ব দিলে বৈষম্য কমবে এবং যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো এম হেলাল আহমেদ জনির মতে, শুধু নীতিমালা প্রণয়ন করলেই হবে না, এর কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষতা ও যোগ্যতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদেও পরিবর্তন এসেছে, তবু সুশাসনের ঘাটতি রয়ে গেছে। এজন্য স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীনে পরিচালিত হয়। নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়গুলো সম্পূর্ণভাবে ওই বিভাগই দেখে। প্রয়োজনে কর্মকর্তারা বিভাগটির সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
ইএআর/এমআইএইচএস