নেপালের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে রাজধানী কাঠমান্ডুতে আন্দোলনের প্রস্তুতি নেওয়া তরুণদের ব্যঙ্গ করে বলেন, নিজেদের জেনারেশন জেড বলে দাবি করলেই কি যা খুশি দাবি করা যায়?
এর ৪৮ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়াতে বাধ্য হন তিনি। কারণ পুলিশের গুলিতে ১৯ জন নিহত হওয়ার পর আন্দোলন আরও তীব্র হয় এবং বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন ও একাধিক রাজনীতিকের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেন। পরপর সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। শেষমেশ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগেই পরিস্থিতির নাটকীয় মোড় নেয়।
নেপালের এই রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধু ৩ কোটি জনসংখ্যার এই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এর প্রভাব পড়তে পারে গোটা দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্ব রাজনীতিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালের ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস এবং ভারত-চীন-পাকিস্তানের সঙ্গে এর কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টার কারণে দেশটির রাজনৈতিক পরিবর্তন বহুমাত্রিক গুরুত্ব বহন করে।
নেপাল একটি স্থলবেষ্টিত দেশ, যার উত্তরে চীন এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত। দেশটিতে বিশ্বের ১৪টি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের মধ্যে ৮টির অবস্থান, যার মধ্যে রয়েছে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট।
ঐতিহাসিকভাবে ভারত-ঘনিষ্ঠ হলেও নেপালের পররাষ্ট্রনীতিতে ঘন ঘন পরিবর্তন এসেছে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অলি চীনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। তার পদচ্যুতি কাঠমান্ডুতে চীনের প্রভাব কমার ইঙ্গিত এবং ভারতের প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
সামাজিক আন্দোলন ও রাজনীতিবিদবিষয়ক গবেষক লোকরঞ্জন পরাজৌলি বলেছেন, পরবর্তী অন্তর্বর্তী নেতা সম্ভবত কোনো স্বাধীন ব্যক্তি হবেন, যিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নন এবং সেনাবাহিনীর আস্থাভাজন হবেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কির নামও সম্ভাব্য অন্তর্বর্তী নেতার তালিকায় আছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তার রাজনৈতিক অবস্থান ও কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো স্পষ্ট নয়।
একইসঙ্গে আলোচনায় রয়েছেন কাঠমান্ডুর তরুণ মেয়র, র্যাপার ও জনপ্রিয় নেতা বালেন্দ্র শাহ, যিনি ২০২২ সাল থেকে নগর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন।
তবে কাঠমান্ডুর এক প্রবীণ মানবাধিকারকর্মী বলেন, নেতা যেই হোন না কেন, ভারত ও চীন উভয়ই এমন সরকার চাইবে যারা তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে। কোনো পক্ষই অন্যপক্ষের প্রভাব নেপালে বাড়ুক, তা চায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অলি সরকার পতনের পর ভারতের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ তৈরি হয়েছে। এমনকি ভারতের বিজেপির কিছু অংশ নেপালের রাজতন্ত্রপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে সহমত পোষণ করে থাকে, যারা মনে করে রানা শাসন ফেরানো দরকার।
এ বছরের শুরুর দিকে সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে হাজার হাজার মানুষ রাজকীয় অভ্যর্থনা জানায়, যা রাজতন্ত্রের প্রতি এখনও একটি বড় অংশের জনসমর্থনের ইঙ্গিত দেয়। যদি বর্তমান সংকটে রাজতন্ত্রপন্থিরা লাভবান হয়, তবে ভারতের ডানপন্থি রাজনীতির জন্য তা ইতিবাচক হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষক আলি হাসান।
তবে জেনারেশন জেড আন্দোলনের নেতারা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তারা রাজতন্ত্রে ফিরে যেতে চান না।
নেপাল ও পাকিস্তানের সম্পর্ক বরাবরই সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও কৌশলগত দিক থেকে খুব গভীর নয়। তবে অতীতে ভারতকে কৌশলগত বার্তা দিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবহার করেছে নেপাল।
১৯৬০ সালে ভারত যখন রাজা মহেন্দ্রর বিরুদ্ধে সমালোচনা করে, তখন তিনি পাকিস্তান সফরে যান এবং ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে আতিথেয়তা দেন।
সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময়ও, মে মাসে নেপাল পাকিস্তানের জাতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানায়, যা দিল্লির উদ্বেগ বাড়ায়।
বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও এখন প্রশ্ন উঠছে—নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো তাদের রাজনীতিও কি একই ধরনের গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে পারে?
সূত্র: আল-জাজিরা
এমএসএম