পবিত্র ঈদুল ফিতর বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ

1 day ago 11

আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ এক মাস সিয়াম-সাধনার পর ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন করছে। ঈদ শব্দটি আরবি, এর বাংলা অর্থ খুশি, আনন্দ, আনন্দোৎসব ইত্যাদি। আর ফিতর অর্থ রোজা ভাঙা, খাওয়া ইত্যাদি। তাহলে ঈদুল ফিতর এর অর্থ দাঁড়ায় রোজা শেষ হওয়ার আনন্দ। মুসলিম উম্মাহ বছরে দু’টি ঈদ পালন করে থাকে আর তা হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। একটি আসে পবিত্র মাহে রমজানে রোজা পালনের মাধ্যমে আর অপরটি আসে হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের মহান কুরবানির স্মৃতিরূপে পশু কুরবানির মাধ্যমে।

মুসলিম উম্মাহ ঈদ আল্লাহ পাকের শোকরানা স্বরূপ আদায় করে থাকেন। বছরে দুইবার এই উৎসব খুশি ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে ফিরে আসে। মহান আল্লাহ প্রতি বছর ঈদের মাধ্যমে বান্দাকে তার দয়া ও করুণা বর্ষণ করেন। সিয়াম পালনের দ্বারা রোজাদার যে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার সৌকর্য দ্বারা অভিষিক্ত হন, ইসলামের যে আত্মশুদ্ধি, সংযম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দানশীলতা, উদারতা, ক্ষমা, মহানুভবতা, সম্প্রীতি ও মনুষ্যত্বের গুণাবলি দ্বারা বিকশিত হন, এর গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখার শপথ গ্রহণের দিন হিসেবে ঈদুল ফিতর আগমন হয়। একজন আল্লাহপ্রেমিক মাত্রই তার সকল আনন্দ খোদার সন্তুষ্টির সাথেই যুক্ত করে।

তাই একজন প্রকৃত আল্লাহপ্রেমিক খোদার সন্তুষ্টি লাভের সুযোগ পেলে শোকরানা আদায় করে থাকে আর ঈদ আমাদের সেই শোকরানা আদায়ের সুযোগ করে দেয়। তাই সকলে মিলে-মিশে শোকরানা স্বরূপ দুরাকাত নামাজের মাধ্যমে ঈদ পালন করে মুসলিম উম্মাহ।

আল্লাহপাকের খাস রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের এক মাস সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝে যে ঈদ আসে তা হলো ঈদুল ফিতর। ঈদ উপলক্ষ্যে নির্মল আনন্দের এক পরিবেশ বিরাজ করে সর্বত্র। সামাজিক ভেদাভেদ ও বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে এই ঈদুল ফিতরে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে চলে। একজন রোজাদারের জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হলো খোদাতায়ালার আদেশ অনুযায়ী মাসব্যাপী রোজা রাখতে আল্লাহ তাকে তৌফিক দিয়েছেন। তাই তিনি আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করতে ও আনন্দ প্রকাশ করতেই রমজান মাস শেষ করে শাওয়াল মাসের ১লা তারিখে ঈদের আনন্দে মিলিত হয়। আর এই দিনটির মাধ্যমে আল্লাহপাক মুমিনের জন্য সকল বৈধ খাবার ও পানীয় ও কাজ কর্ম যা কিনা রোজার কারণে বিরত রেখে ছিলেন তার অনুমতি প্রদান করেন। মুসলমানদের জন্য ঈদের চাঁদ অত্যন্ত আনন্দের মুহূর্ত। কারণ চাঁদের হিসাবেই ঈদ পর্ব শুরু হয়। রমজান মাসের শেষ দিন মুসলমান মাত্রই হোক সে বৃদ্ধ, যুবক কিংবা শিশু, চাঁদ দেখা বা চাঁদের খবর নিতে উৎসুক দেখা যায়।

আমাদের প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ঈদের চাঁদ দেখার জন্য উৎসুক থাকতেন। তিনি (সা.) চাঁদ দেখা মাত্র এই দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনে ওয়াল ঈমানে, ওয়াস্ সালামাতে, ওয়াল ইসলামে, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহু হিলালুর রুশদিউ ওয়া খাইর’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! এই চাঁদকে আমাদের উপর উদিত কর নিরাপত্তা, ইমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে। (হে চাঁদ) তোমার ও আমার প্রভু একমাত্র আল্লাহ। হে আল্লাহ! এ চাঁদ যেন সঠিক পথের ও কল্যাণের চাঁদ হয়। (ইমাম তিরমিজি)।

তাই আমাদের উচিত হবে ঈদের চাঁদ দেখে উক্ত দোয়াটি করা, এই চাঁদ যেন আমাদেরকে আল্লাহপাকের পথে নিয়ে যায়। ঈদের পূর্বে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী, শিশু এমনকি সদ্য জন্মলাভকারী শিশুর জন্যও নির্ধারিত ফিতরানা আদায় করা জরুরি। ফিতরানার টাকা দিয়ে গরীব, অসহায় দুঃস্থগণ অন্যান্যদের সাথে ঈদের আনন্দ করে থাকে। যেহেতু ফিতরানার টাকা দিয়ে দুঃস্থ অসহায়গণ ঈদ করে তাই ঈদের কিছুদিন পূর্বে এই টাকা আদায় করা সবচেয়ে উত্তম। এ ফিতরানা ঈদের নামাজের আগেই আদায় করা উচিত।

কেননা গরীব রোজাদার যেন ফিতরানার অর্থ দিয়ে ঈদের খুশিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। ফিতরানা দেয়া কারও ওপর কোনো প্রকার অনুগ্রহ নয়। এটা আমাদের জন্য ইবাদতের অংশ। এমনকি যে ব্যক্তিকে ফিতরানার সাহায্য দেয়া হয়, তার নিজের পক্ষ থেকেও ফিতরানা দেয়া কর্তব্য। সকলের অংশগ্রহণের ফলে সদকাতুল ফিতরের ফান্ডটি একটি সাধারণ ফান্ডে পরিণত হয়। যার ফলে এ থেকে যারা উপকৃত হয় তাদের মনে হীনম্মন্যতার ভাব সৃষ্টি হয় না। মূল বিষয় হলো ফিতরানা আদায়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের গরীব ভাইদের দু:খ-কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারি এবং তাদেরকেও ঈদের আনন্দে অন্তর্ভুক্ত করি।

যাদেরকে আল্লাহতায়ালা ধন-সম্পদ দিয়েছেন তারা আল্লাহর রাস্তায় এবং গরীব অসহায়দের প্রতি যতই দান করুক না কেন এতে কিন্তু তার ধন-সম্পদে কমতি দেখা দিবে না বরং বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য মূলত মহান আল্লাহপাকের কৃতজ্ঞতা আদায় করা। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি হাসিল করে তারই ইবাদতের মাধ্যমে শোকরানা আদায় করে এটাকে বাস্তবে প্রকাশ করা।

তাই এই আনন্দ শুধু খুশি বা মজার জন্য নয় বরং আপন প্রভুর বান্দা হিসাবে স্থায়ীভাবে ইবাদত প্রতিষ্ঠায় রত থাকা। এছাড়া ঈদ সবাইকে সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধার সওগাত নিয়ে আসে। এর আনন্দ থেকে ধনী-নির্ধন কেউ বঞ্চিত নন।

ঈদের ইবাদতে শরীয়ত নির্দেশিত কিছু বিধি-বিধান রয়েছে, যা পালনে সামাজিক জীবনে পারস্পরিক আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও বন্ধন সুসংহত হয়। ঈদুল ফিতরের শরীয়ত দিক হলো, ঈদের নামাযের পূর্বে রোযার ফিতরানা ও ফিদিয়া আদায় করা, ঈদ গাহে দু’ রাকাত নামায আদায় করা, খুতবা শুনা এবং উচ্চস্বরে তাকবির পাঠ করা। ঈদে আমাদের দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি ঘটে আর পরস্পরের মাঝে ঈমানী ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয় এবং নিজেদের মাঝে হিংসা বিদ্বেষ দূর হয়ে এক স্বগীর্য় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যদি এমনটা হয় তাহলেই আমাদের এ ঈদ পালন ইবাদতে গণ্য হবে।

সুনানে ইব্ন মাজাহ গ্রন্থে ঈদের ফজিলত সম্পর্কে এসেছে, যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে ইবাদত করবে তার অন্তরকে আল্লাহতায়ালা রহমত ও বরকতের বারিধারা দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেবেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ) একদিকে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন করছে আর অপর দিকে ফিলিস্তিনের মুসলিম ভাইয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে, পাকিস্তানে আহমদিয়াসহ বিভিন্ন মত ও ফেরকার অনুসারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশে হাজারো নিরীহ মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। দেশে দেশে মজলুম মানুষের আহাজারি ভেসে আসছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এসব মজলুমদের সাহায্যে আমাদের যদি কিছুই করা সম্ভব না হয় কমপক্ষে তাদের শান্তি কামনা করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে দুহাত তুলে ক্রন্দন হৃদয়ে দোয়া তো আমরা করতে পারি। এসব নির্যাতিত মুসলমানদের জন্য আমাদের সব সময় দোয়া করা উচিত।

তাই আসুন, ঈদের আনন্দে বিশ্বের মজলুম ভাইদের জন্য দোয়া করি আর আপন পর সবার সাথে গড়ে তুলি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। ঈদুল ফিতর মানুষে মানুষে বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করবে আর ভেদাভেদ ও হানাহানি থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ একে অপরের শান্তি কামনা করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/এমএস

Read Entire Article