পরিবেশ ও জীবনে পর্বতের গুরুত্ব অপরিসীম

2 weeks ago 15

প্রকাশ ঘোষ বিধান

প্রকৃতির অপরূপ দান পর্বত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ আধার বলা হয় পর্বতকে। পাশাপাশি নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর সঙ্গে এখানে আছে স্বাদু বা মিঠাপানির উৎস। নান্দনিক সৌন্দর্যের সমারোহে পর্বত মানুষকে মুগ্ধ করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পার্বত্য জেলাগুলো ভ্রমণপিপাসু মানুষের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস পালিত হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়। জনজীবনে পর্বতের তাৎপর্য ও পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে ২০০৩ সাল থেকে ১১ ডিসেম্বর পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস। দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হলো, আমাদের জীবনে পর্বতের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। ২০০২ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস হিসেবে চূড়ান্ত করে। এরপর ২০০৩ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস পালন করা হয়।

পর্বত আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ হটস্পট এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহকারীর উৎস বলা হয় পর্বতকে। ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ২৭ শতাংশজুড়ে রয়েছে পর্বতমালা। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশের বাস পর্বতে। বিশালতা আর দৃঢ়তার প্রতীক পর্বত পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার অন্যতম উপাদান। মানবজাতির আনুমানিক অর্ধেককে সুপেয় পানি সরবরাহ করে পর্বত। এ ছাড়া গাছপালা এবং প্রাণিদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। ভাষা ও ঐতিহ্যের দিক থেকে বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায়ের আবাসস্থল পর্বত। তবে পর্বতগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ধুঁকছে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস পালন করা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রায় সব ধর্মেই পর্বত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রিসে মাউন্ট অলিম্পাস যা দেবতাদের আবাসস্থল হিসেবে বিবেচিত। জাপানে মাউন্ট ফুজির আগ্নেয়গিরিকেও পবিত্র বলা হয়। চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের কৈলাশ পর্বতকে হিন্দুধর্ম, বন, বৌদ্ধ এবং জৈন এ চারটি ধর্মে পবিত্র বলে মনে করে। আয়ারল্যান্ডে মাউন্ট ব্র্যান্ডন, মাউন্ট আরারাত, ইউরোপে আল্পস পর্বতমালা পবিত্র বলে মনে করা হয়।

মানুষের জীবনে পর্বতের গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর মোট স্থলভাগের এক-চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি প্রায় ২৭ শতাংশ জায়গা জুড়ে আছে বিস্তৃত পর্বতরাশি। এ পর্বতরাশি থেকে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে পৃথিবীর ২২ শতাংশ মানুষ। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ পর্বত থেকে আহরিত সম্পদ দ্বারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছে। পৃথিবীর প্রায় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মিঠাপানির উৎস পর্বত। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবন অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। পর্বতমালা, নদ-নদী, বহু প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী এ অঞ্চলকে করেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ।

পাহাড়ের কোনো সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই, যার ফলে তাদের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। উচ্চতা, আয়তন, ত্রাণ, খাড়াতা, ব্যবধান এবং ধারাবাহিকতা একটি পর্বতকে সংজ্ঞায়িত করার মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ভূমিরূপকে পর্বত বলা হবে কি না তা স্থানীয় ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। যেসব পাহাড়ের উচ্চতা ২০০০ ফুট বা ৬০০ মিটারের ওপরে সেগুলোকে পর্বত বলা হয়। আর উচ্চতা ২০০০ ফুট বা ৬০০ মিটারের নিচে হলে সেগুলোকে পাহাড় বলা হয়। প্রাকৃতিক ভূগোলের ভাষায় পাহাড় হলো; সমুদ্র সমতল হতে উচ্চে অবস্থিত ঢাল বিশিষ্ট শিলাস্তূপকে বলে পাহাড়। অপেক্ষাকৃত কম উঁচু মাটির স্তূপকে বলে পাহাড়। সাধারণত ৬০০ থেকে ১০০০ মিটার উঁচু স্বল্প বিস্তৃত শিলাস্তূপ পাহাড় নামে পরিচিত আর সমুদ্র সমতল হতে অতিউচ্চে অবস্থিত খাড়াঢাল বিশিষ্ট শিলাস্তূপকে বলা হয় পর্বত। সমুদ্রতল থেকে অন্তত ১০০০ মিটারের বেশি উঁচু সুবিস্তৃত ও খাড়া ঢালবিশিষ্ট শিলাস্তূপ পর্বত নামে পরিচিত। পাহাড়ের চূড়া থাকে না আর ঢালটাও কম কিন্তু পর্বতের চূড়া অনেক উঁচু হয় আর খাড়া ঢাল থাকে। হিমালয়, তাজিনডং, কেওকাড়াডং এগুলোকে পর্বত বলা হয়। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত হলো এশিয়ার এভারেস্ট পর্বত হিমালয় পর্বতমালা, যার চূড়ার গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৮৪৮.৮৬ মিটার বা ২৯০৩১.৬৯ ফুট।

বর্তমানে পৃথিবীতে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, বৃক্ষরাজি ধ্বংস, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যার আধিক্য, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ এবং পর্বতের তুষার ও ভূমিধসসহ নানা ক্ষয়ের কারণে প্রকৃতি ও পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে প্রকৃতিসৃষ্ট পর্বতগুলো হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। মানুষের আগ্রাসী থাবায় পাহাড় কাটার ফলে বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে, ভূমিধসের ঘটনা ঘটছে, পরিবেশের ভারসাম্যও ধংস হচ্ছে। পর্বত ধ্বংসের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে, জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে, পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ত্বরান্বিত হচ্ছে।

বাংলাদেশে মোট ভূমির এক পঞ্চমাংশ হচ্ছে পর্বত্য অঞ্চল। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আট ভাগ পার্বত্য অঞ্চল অবস্থিত। বাকি দশভাগ অবস্থিত দেশের অন্যান্য অঞ্চলে। সিলেট অঞ্চলে বেশ কিছু পাহাড় বা টিলা রয়েছে। পাহাড় থেকে জল, খাদ্য, ওষুধ শক্তির মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস পাওয়া যায়। তবে ক্রমবর্ধমান পর্যটন ও উন্নয়নের কারণে সেগুলোর অনেক ক্ষতি হচ্ছে, এ বিষয়ে মনোযোগ না দিলে ভবিষ্যতে অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। পাহাড়ের সংরক্ষণ শুধু মানুষের জন্যই নয়, সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলানিকেতন পর্বত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই পাহাড়ি প্রকৃতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবন সংস্কৃতি ও কৃষ্টি স্বমহিমায় অনন্য করে তুলেছে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে রেখেছে। বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের পাহাড়ি মানুষের জীবমান উন্নয়নে ও পার্বত্য প্রতিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। জনজীবনে পর্বতের তাৎপর্য ও পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে পার্বত্য এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে জনজীবনে পর্বতের তাৎপর্য ও পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে সহায়ক হবে। নিজেদের বাঁচার তাগিদেই প্রকৃতিসৃষ্ট পর্বত ও পরিবেশকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন অপরিহার্য।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এসইউ/জেআইএম

Read Entire Article