শীত আগমনের শুরুতেই পরিযায়ী পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে উঠছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার শিবরামপুর গ্রাম। লম্বা পা ও ঠোঁটের হালকা ধূসর বর্ণের দেখতে পাখিগুলো। এদের ডানা ঝাপটানি ও কিচিরমিচির শব্দে প্রাণবন্ত করে তুলেছে পুরো এলাকার পরিবেশ।
এরমধ্যে কর বাড়ির বাগানের উঁচু গাছে বাসা বেঁধে প্রজনন শুরু করছে হাজার হাজার ধূসর পালকের বড় আকারের শামুকখোল (ওপেন বিল) পাখি।
এদিকে পাখিগুলোর আগমনে বাগান মালিক ও প্রকৃতিপ্রেমীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসছে এ পাখি ও তার আবাসস্থল দেখতে। অনেকে আবার তাদের ক্যামেরায় তুলছেন পাখির ছবি। তবে কিছু অসাধু ব্যক্তি পাখি শিকার বা বিরক্ত করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাগান মালিক ও স্থানীয়দের দাবি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এ অতিথি পাখিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন খুবই জরুরি। প্রশাসনসহ সবার সহযোগিতায় কর বাড়ির বাগান হোক পাখির নিরাপদ আশ্রয় (অভয়ারণ্য)।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও উষ্ণতা ও খাদ্যের খোঁজে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি উড়ে এসেছে শিবরামপুর গ্রামের কর বাড়ির বাগানে। প্রায় ৭ থেকে ৮ মাস আগে এখানে এ পাখির আগমন হলেও এখন সংখ্যা আরও বাড়ছে। প্রায় প্রতিটি বাসায় রয়েছে ডিমসহ পাখির বাচ্চা। এদের প্রধান খাদ্য শামুক। প্রতিদিন সকালে পাখিগুলো আশপাশের জলাশয়, বিল ও পুকুরে যায় খাবারের সন্ধ্যানে, খাবার নিয়ে নীড়ে ফিরে বিকাল বা সন্ধ্যায়। ততক্ষণ ডিম ও বাচ্চা পাহারায় থাকে অন্যপাখি।
এদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দে কর বাড়ির মানুষ বিরক্ত না হয়ে উল্টো পাখির নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে এবং সঙ্গে সহযোগিতা করছে স্থানীয়রা।
অন্যদিকে পাখি দেখতে প্রতিদিন কর বাড়ির বাগানে ভিড় করছে শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ। ক্যামেরা বন্দি করছেন প্রিয় মুহূর্ত।
স্থানীয় আকাশ কর বলেন, আমাদের গ্রামে এবার অনেক অতিথি পাখি এসেছে। গত বছরের চেয়ে এবারের সংখ্যা বেশি, প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার হবে । পাখিগুলো দেখে আমাদের খুব ভালো লাগে। বাইরে থেকে অনেক মানুষ দেখতে আসছে, ছবি তুলছে। দেখে খুব ভাল লাগছে। এ পাখি কেউ যাতে স্বীকার করতে না পারে এজন্য সব সময় খেয়াল রাখছি। তবে সরকারসহ প্রশাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। বাগানের সব গাছে পাখি বাসা বেঁধেছে। প্রতিটি বাসায় ডিম ও বাচ্চা আছে।
মজিবর শেখ বলেন, গত বছরের চেয়ে এবার অনেক বেশি পাখি এসেছে । অনেকে মারতে আসে কিন্তু আমরা মারতে দেই না । দিন রাত পাখিগুলো পাহারা দেই। ওরা সকালে খাবারের খোঁজে যায় এবং সন্ধ্যার আগে খাবারসহ বাসা তৈরির ডালপালা নিয়ে আসে। যখন ওর, তখন দেখতে খুব ভাল লাগে। আমি চাই পাখিগুলো এখানে থাকুক।
দর্শনার্থী হামিদুল ফারাবি বলেন, অতিথি পাখির খবর পেয়ে আমি পাংশা থেকে এখানে দেখতে এসেছি এবং দেখে খুব ভালো লাগতেছে। এখানে নাকি অনেকে এসে পাখিগুলো স্বীকার করতে চায়। আমি চাই পাখিগুলো রক্ষা করতে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। কারণ এ পাখিগুলো আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
বাগান মালিক মুকুল কর ও রুপা কর বলেন, আমাদের পুকুর চালায় হাজার হাজার পাখি প্রায় ৮ থেকে ৯ মাস ধরে বাসা বেঁধে আছে। এবার গত বছরের চেয়ে এবার অনেক বেশি পরিমাণে পাখি এসেছে। ওদের কিচিরমিচির শব্দ খুব ভালো লাগে এবং অনেকেই ক্যামেরা, ড্রোন নিয়ে দেখতে আসছে। আবার অনেকে পাখিগুলো মারতে আসে, তখন বাঁধা দিলে তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। তারপরও চেষ্টা করছি পাখিগুলোকে রক্ষা করতে।
তারা আরও বলেন, প্রায় প্রতিটি পাখির বাসায় ডিম ও বাচ্চা আছে। দুষ্টু ছেলে পেলে এয়ারগান নিয়ে এসে পাখি ও পাখির বাচ্চাগুলোকে মারাসহ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কয়েকমাস ধরে বাঁধা দিয়ে আসছি এবং বন বিভাগকে বিষয়টি জানিয়েছি। সরকার যেন এ পাখিগুলো রক্ষা করে এটাই আমার দাবি ।
পাখি প্রেমী সাংবাদিক লিটন চক্রবর্তী বলেন, আমার ঘরের মাধ্যমে আমরা জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করে থাকি। শুনেছি ওখানকার অনেক উঁচু উঁচু গাছ থেকে পাখিগুলো পড়ে আহত হচ্ছে । সেই পাখি কেউ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ খেয়ে ফেলছে। সে ক্ষেত্রে কেউ যদি অসুস্থ পাখি পায় এবং আমাদের কাছে দেয়। তাহলে আরাম ঘরের মাধ্যমে পাখিকে সুস্থ করে প্রশাসনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করতে পারবো।
রাজবাড়ী সামাজিক বনায়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর সায়েদুর রহমান বলেন, পাখিগুলো নিয়মিত নজরদারির মধ্যে রয়েছে। কোনো দুষ্কৃতিকারী যেন এ অতিথি পাখিকে ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য টহল কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। পাখির নিরাপত্তায় প্রতিদিন অফিসের একজন স্টাফ বিকেল থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত ওখানে দ্বায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া বিষয়টি জেলা প্রশাসন এবং বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের অবগত করা হয়েছে। জনসচেতনতা তৈরিতে ওই এলাকায় মাইকিংসহ সাইনবোর্ড স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রুবেলুর রহমান/আরএইচ/জেআইএম