রাসায়নিক কারখানা ও গুদামে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর মিছিল বাংলাদেশের নগর জীবনের এক স্থায়ী ট্র্যাজেডি হয়ে উঠেছে। গত ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে আবাসিক এলাকার মধ্যে রাসায়নিকের গুদামে সকাল সাড়ে এগারোটায় ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর আট ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও নেভানো সম্ভব হয়নি।
এসব কারখানার অধিকাংশই আবাসিক এলাকায় গড়ে তুলেছে বিষের গুদাম। দাহ্য, দাহ্যতর, অত্যন্ত দাহ্য এই তিন ধরনের রাসায়নিক পদার্থে ভর্তি ড্রাম, ক্যান বা ব্যারেলগুলো থাকে বাড়ির নিচতলায়, দোকানের পেছনে বা গলির ভেতর কোনো পরিত্যক্ত ঘরে। আশপাশে ঘুমিয়ে থাকে শিশু, বৃদ্ধ, নারী যাদের কোনো ধারণাই নেই যে, তারা একেকজন বারুদের স্তূপের ওপর বসবাস করছে। কোনোদিন হয়তো একটি সিগারেট, একটি শর্ট সার্কিট কিংবা গ্যাস লিক হয়ে সেই মৃত্যুর ট্রিগার টেনে দিচ্ছে।
আমাদের বড় বড় শহরের ঘরবসতিতে হঠাৎ আগুন লাগে চোখের পলকে লেলিহান শিখা গিলে খায় জীবন, ঘর, স্বপ্ন। চারদিকে শুধু ধোঁয়া, কান্না আর হাহাকার। আবারও পত্রিকার শিরোনামে উঠে আসে রাসায়নিক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, হয় বহু নিহত। ঘটনা নতুন নয় শুধু এলাকার নামটুকু বদলায়। কখনো চকবাজার, কখনো আরমানিটোলা, কখনো সীতাকুণ্ড বা নারায়ণগঞ্জ। আগুনের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যায় অগণিত প্রাণ, অথচ দায়সারা প্রতিবেদন আর অল্পকালের হইচই শেষে সব আবার আগের মতো নিস্তব্ধ। যেন মৃত্যুর গন্ধও এই শহরে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
প্রতিবারই প্রশাসন ঘটনাস্থলে ছুটে যায়, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, আশ্বাস দেওয়া হয় কঠোর ব্যবস্থার। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনগুলো খুব কমই প্রকাশ্যে আসে, আর যেগুলো আসে, সেগুলোর সুপারিশ থাকে বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের জন্য সরকার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু গত ছয় বছর পরও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বরং গলির ভেতর গোপনে নতুন নতুন গুদাম গড়ে উঠছে। অর্থ আর প্রভাবের রাজনীতিতে নিরাপত্তা এখানে পরাজিত।
এদেশে শিল্পায়নের নাম করে অনেকে যে অবৈধ কারখানা চালায় তাতে নেই পরিবেশ ছাড়পত্র, নেই ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন, নেই রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার নিরাপত্তা মান। অথচ এসব কারখানার মালিকদের অনেকেই স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, কেউ কেউ জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত। ফলে প্রশাসনও অনেক সময় চোখ বুজে থাকে। এর ফলভোগ করে সাধারণ মানুষ। যাদের ঘরবাড়ি, জীবন, পরিবার মুহূর্তে ছাই হয়ে যায়।
এই অনিয়মের মূল কারণ দুইটি। তা হচ্ছে দুর্নীতি ও উদাসীনতা। একদিকে অর্থলোভে কারখানার মালিকেরা মৃত্যুফাঁদ তৈরি করেন, অন্যদিকে তদারকি সংস্থাগুলো দায়িত্বহীনতার বৃত্তে আটকে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের হাতে সীমিত জনবল, পুরোনো যন্ত্রপাতি ও জটিল ব্যুরোক্রেসি। সব মিলিয়ে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ নয়, শুধু পরবর্তী উদ্ধারই তাদের নিয়মিত কাজ হয়ে গেছে।
রাসায়নিক পদার্থ ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই আইন ও নীতিমালা রয়েছে। যেমন পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ আইন, বিল্ডিং কোড, ও শ্রম আইন। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রায় সম্পূর্ণ ব্যর্থতা লক্ষ্য করা যায়। যারা এই আইনের প্রয়োগের দায়িত্বে, তারা যদি আগুন লাগার পরেই সক্রিয় হন, তবে আগুনের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে তাদের এই নীরবতা।
আরেকটি মানবিক দিকও উপেক্ষিত থেকে যায় অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের পরিবারগুলোর জন্য। কারো স্বামী, কারো সন্তান, কারো বাবা আগুনে পুড়ে মারা গেলে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক দিয়ে কি সেই শূন্যতা পূরণ হয়? আহতদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা, পুনর্বাসন বা মানসিক সহায়তার কোনো সমন্বিত কর্মসূচি সাধারণত দেখা যায় না। কিছু সহানুভূতি, কিছু মিডিয়া কাভারেজ—তারপর তারা হারিয়ে যায় শহরের কোলাহলে।
প্রতিটি আগুনের পর আপনজনের আহাজারি আমাদের কানে বাজে আর মানুষ বলাবলি করতে থাকে বাড়ির পাশে ছিল বিষাক্ত রাসায়নিকের বিপুল মজুদসহ গুদাম কেউ কেন তা আগে দেখেনি? কর্তৃপক্ষ দেখে থাকলে তার প্রতিকার কেন করেনি বা এখনও করছে না? এই প্রশ্নের উত্তর আর কেউ দিতে না চাইলেও রাষ্ট্রকে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে।
এখন সময় এসেছে, রাসায়নিক কারখানার এই বিষের গুদাম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় শুদ্ধ অভিযান চালানোর। যে-সব কারখানা আবাসিক এলাকায় চলছে, সেগুলো দ্রুত সিলগালা করতে হবে, মালিকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে রাসায়নিক শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা, নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করা জরুরি।
গত ১৪ অক্টোবর রূপনগরের আবাসিক এলাকার মধ্যে রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডে ভয়ানক দৃশ্য দেখা গেছে। আগুনের লেলিহান শিখা মুহূর্তে গিলে ফেলেছে তাজা জীবন, স্বপ্ন, আশ্রয়। রাসায়নিকের বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, দগ্ধ আর্তনাদ, আর অসহায়ের মতো ছুটে বেড়িয়েছে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ। রাত পর্যন্ত মিলেছে শুধু ১৬টি নিথর দেহ। যাদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য ছিলেন। রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডের এই ভয়াবহতা আমাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমরা এখনো বাড়ির পাশে বিষের গুদাম নামের এক মরণফাঁদে বাস করছি।
রূপনগরের ঘটনাটি একটি ধারাবাহিক অগ্নিদুর্ঘটনার প্রতীক। এর আগেও পুরান ঢাকার চকবাজার, আরমানিটোলা, কেরানীগঞ্জ বা সীতাকুণ্ডে একই চিত্র দেখা গেছে। প্রতিবারই অগণিত প্রাণহানি, প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ, তদন্ত কমিটি, আশ্বাস, এবং কিছুদিন পর সব ভুলে যাওয়া। যেন মৃত্যুও এখন আমাদের উন্নয়নের সহচর।
রূপনগরের গুদামটিতে অনুমোদন ছাড়াই বছর বছর রাখা হচ্ছিল দাহ্য পদার্থ। চারপাশে ছিল গার্মেন্টস কারখানা, আবাসিক ভবন, ভেতরে শ্রমিকদের ঘর, একটু পাশে শিশুদের স্কুল। অথচ কেউ জানত না এই নিরীহ ভবনের নিচে লুকিয়ে আছে বারুদের স্তূপ। এক টুকরো স্পার্ক, এক মুহূর্তের অসতর্কতা, আর মুহূর্তেই তা পরিণত হলো মৃত্যুর উৎসবে।
গণমাধ্যমে জানা গেছে এই দাহ্য রাসায়নিক সংরক্ষণাগারের কোনো অনুমোদন নেই। কেন এসব কারখানা বছরের পর বছর অনুমোদন ছাড়াই চলতে পারে? কেন স্থানীয় প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ অধিদপ্তর সবাই একসঙ্গে ব্যর্থ হয়? এ প্রশ্ন এখন রূপনগরের প্রতিটি শোকাহত পরিবারের বুকফাটা কান্নার মতোই জ্বলন্ত। তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে, হবে আরও অনেক। কিন্তু তদন্তের ফলাফল যতদিন আলোর মুখ না দেখে, ততদিন এই আগুন নিভবে না। শুধু জায়গা বদলাবে।
রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণ ও ব্যবহার বিষয়ে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন স্পষ্ট। দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ আইন ১৯৫২, বিল্ডিং কোড ২০০৮, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সবই বলছে, আবাসিক এলাকায় এ ধরনের শিল্প স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই আইন প্রয়োগের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কারখানা মালিকদের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়া থাকলে, আইন যেন সেখানে পৌঁছাতে পারে না।
ফায়ার সার্ভিস দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছে শুধু পুরান ঢাকায় নয়, ঢাকার চারপাশের উপশহরেও শত শত অবৈধ রাসায়নিক কারখানা চলছে। তাদের তালিকা আছে, প্রতিবেদন আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। কারণ, প্রশাসনিক অভিযানের গতি যতটা জোরালো হয় দুর্ঘটনার পরপরই, ঠিক ততটাই শীতল হয়ে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
অন্যদিকে, প্রতিবারের মতো এবারও নিহতদের পরিবারগুলো পড়ে গেল চরম অনিশ্চয়তায়। যাদের প্রিয়জন আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল, তাদের জীবনে ফিরে এল ভয়াবহ আর্থিক ও মানসিক সংকট। অগ্নিদগ্ধ আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহন, পরিবারের পুনর্বাসন, এসব এখনো কোনো সমন্বিত নীতির আওতায় আসেনি। প্রতিবার ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ঘোষণা হয়, কিন্তু জীবনের ক্ষত কি টাকা দিয়ে পূরণ হয়?
এখন সময় এসেছে, এই মৃত্যু চক্র থামাতে রাষ্ট্রকে কঠোর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে। সকল অবৈধ রাসায়নিক কারখানাগুলো অবিলম্বে সিলগালা ও স্থানান্তর করতে হবে। শুধু পুরান ঢাকায় নয়, ঢাকার চারপাশের অঞ্চলেও। রাসায়নিক শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে হবে।, যেখানে থাকবে যথাযথ অগ্নি-নিরাপত্তা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশিক্ষিত কর্মী। নিরাপত্তা লাইসেন্স নবায়ন ডিজিটালভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে যাতে কেউ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পার না পায়। এছাড়া নাগরিক সচেতনতা ও গণমাধ্যমের তদারকি বাড়াতে হবে, যাতে সমাজের মানুষ জানে তাদের আশপাশে কী বিপদ লুকিয়ে আছে।
একটি শহর তখনই সভ্য হয়, যখন সেখানে জীবন নিরাপদ হয়। ঢাকায় প্রতিটি নতুন অগ্নিকাণ্ড যেন প্রমাণ করছে আমরা এখনো সেই নিরাপত্তা অর্জন করতে পারিনি। রূপনগরের ১৬টি প্রাণ হারিয়ে আমাদের জাগানোর কথা ছিল। কিন্তু আমরা যদি আবারও ভুলে যাই, তবে পরবর্তী আগুনে হয়তো কান্নার ভাষাও থাকবে না।
শহরের বহু আবাসিক স্থানে বাড়ির পাশে যদি থাকে অনিয়ন্ত্রিত, অনিরাপদ বিষাক্ত গুদাম তাহলে রূপনগরের মতো কেবল ১৬ পরিবারের আহাজারির চেয়ে আরো বেশী ভয়ংকর শব্দ বার বার শোনার বিষয়টি গোটা জাতির বিবেকের কাছে এক শোক-স্মারক প্রশ্ন রাখতেই থাকবে। তাহলে আমরা কি নতুন কোনো আগুন লাগার অপেক্ষায় আছি? শিয়ালবাড়িতে ১৬ মৃত্যুর পরের দিন চট্টগ্রাম ইপিজেডে ভয়ংকর অগ্নিকাণ্ড সেটাই প্রমাণ করে।
এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি আগুনের পর আপনজনের আহাজারি আমাদের কানে বাজে আর মানুষ বলাবলি করতে থাকে বাড়ির পাশে ছিল বিষাক্ত রাসায়নিকের বিপুল মজুদসহ গুদাম কেউ কেন তা আগে দেখেনি? কর্তৃপক্ষ দেখে থাকলে তার প্রতিকার কেন করেনি বা এখনও করছে না? এই প্রশ্নের উত্তর আর কেউ দিতে না চাইলেও রাষ্ট্রকে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি থাকতে হবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]
এইচআর/এমএস