পশুসম্পদ খাতে বেকারদের কর্মসংস্থান সম্ভব

1 day ago 13

ড. ফোরকান আলী

দিন বদলের অভিযাত্রায় মানুষের কর্মসংস্থান অতি জরুরি। দরিদ্র সীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার হার ১৫%-এ কমিয়ে আনতে হলে মানুষের আয়-রোজগার বাড়াতে হবে। ঘোচাতে হবে বেকারত্ব। শুধু পশুসম্পদ খাতেই আগামী ছয় মাসে এক কোটি লোকের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।

বিবিএস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ ৮৯ হাজারটি এবং কৃষিতে নিয়োজিত জনশক্তি ২ কোটি ২৯ লাখ ৩১ হাজার জন। তাদের কেউ কেউ আবার মৌসুমি বেকারত্ব বা আংশিক বেকারত্বের শিকার। কখনো কাজ থাকে; কখনো কাজ থাকে না। বাংলাদেশে ৪ হাজার ৪৮৮টি ইউনিয়ন এবং ৮৭ হাজার ৬২৩টি ছোট-বড় গ্রাম আছে। প্রতিটি গ্রাম থেকে যদি গড়ে ১২০ জন সুফলভোগী নির্বাচিত করা হয়, তাহলে ৮৭ হাজার ৬২৩টি গ্রাম থেকে মোট ১ কোটি ৫ লাখ ১৪ হাজার ৭৬০ জন সুফলভোগী নির্বাচন করা সম্ভব।

শুধু পশুসম্পদ খাতকে কাজে লাগিয়ে তাদের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। এই ১২০ জন সুফলভোগীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে বেকার যুবক বা যুব মহিলা, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত, শিক্ষিত বেকার যুবক ও উৎসাহী কৃষক। প্রতিটি গ্রাম থেকে ১২০ জন সুফলভোগীর মধ্যে ৩০ জনকে ‘দুধেল গাভি পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ’, ৩০ জনকে ‘গরু মোটাতাজাকরণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ’, ৩০ জনকে ‘ছাগল পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ’ এবং ৩০ জনকে ‘জৈব-নিরাপত্তা সম্পন্ন হাঁস-মুরগির খামার বিষয়ক প্রশিক্ষণ’ দিয়ে তাদের জন্য স্বল্প সুদে বা বিনা সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

তাদের ব্যাংক ঋণ দেবে কাছের বাণিজ্যিক ব্যাংক। ঋণ আদায় করবে কাছের বাণিজ্যিক ব্যাংক। তা তদারকি করবে স্থানীয় পশুসম্পদ অফিস। এ জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ন্যায় স্থানীয় উপজেলা পশুসম্পদ অফিসের মাধ্যমে ‘পশুসম্পদ সম্প্রসারণ কার্যক্রম’ হাতে নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট উপজেলার অধীনস্থ প্রতিটি গ্রাম থেকে নির্বাচন করতে হবে উদ্যমী, পরিশ্রমী ও নিরলস সুফলভোগীকে। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, সেই সাথে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও কারিগরী জ্ঞান দিতে হবে। সঠিকভাবে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের প্রতিটি খামার নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। কোনো সমস্যা দেখা মাত্রই তা সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।

রোগ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাকসিন দিতে হবে। জৈব নিরাপত্তাসহ স্বাস্থ্যসম্পন্ন খামার স্থাপনের বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। খামারিরা যেন পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার দিতে পারে, সেজন্য তাদের পশুপুষ্টি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে। খামার ব্যবস্থাপনা, হাউজিং, লাইটিং, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কে খামার ব্যবস্থাপকের সঠিক ধারণা থাকলে সব খামারই লাভজনক খামারে পরিণত হবে। সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে যেন উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বিশেষ ঋণ হিসেবে ‘সুদবিহীন ঋণ’ বা ‘স্বল্প সুদে ঋণের’ ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

ফসল উৎপাদনের জন্য এ দেশের ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষককে জমির পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ জমির পরিমাণ সীমিত। সব কৃষকের পুকুর তৈরির জমি নেই। কিন্তু যাদের অন্তত বসতভিটা আছে, তার পক্ষে একটি গাভি, দুটি ছাগল, কয়েকটি হাঁস-মুরগি পালন করা সম্ভব। তাই পশুসম্পদ খাতেই এ দেশের কৃষকদের কর্মসংস্থান ও আয়-রোজগার বৃদ্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে।

পশুসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে দুধের চাহিদা ছিল ১৩.০১ মিলিয়ন মোট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছিল ২.৬৫ মিলিয়ন মোট্রিক টন। ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১০.৩৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। জনপ্রতি দুধের চাহিদা প্রতিদিন ২৫০ মিলিলিটার হলেও প্রাপ্যতা ছিল প্রতিদিন মাত্র ৫১ মিলিলিটার। বছরে সারাদেশে মাংসের চাহিদা ছিল ৬.২৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ১.০৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। মাংসের ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫.৩২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। জনপ্রতি মাংসের চাহিদা প্রতিদিন ১২০ গ্রাম হলেও প্রাপ্যতা ছিল প্রতিদিন মাত্র ১৯.৯৮ গ্রাম।

ডিমের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৮২৮ মিলিয়ন। উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ৫ হাজার ৬৫৪ মিলিয়ন। ঘাটতি ছিল ৯ হাজার ১৭৪ মিলিয়ন। জনপ্রতি বছরে ডিমের চাহিদা ১০৪টি হলেও প্রাপ্যতা ছিল মাত্র ৩৯টি। এতেই বোঝা যায়, পশুসম্পদ সম্প্রসারণ কার্যক্রম শুরু করা কতটা জরুরি। বাংলাদেশে পশুসম্পদ একটি বিপুল সম্ভাবনাময় খাত হলেও বছরে জাতীয় অর্থনীতিতে পশুসম্পদের প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২.৪১ শতাংশ। জাতীয় অর্থনীতিতে পশুসম্পদের অবদান ছিল বছরে মাত্র ২.৭৯ শতাংশ। যা অনেক বেশি বৃদ্ধি করা যায়।

শুধু চামড়া থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে বছরে ৪.৩১ শতাংশ; যা আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। গরুর গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার। অর্থবছরে গরুর গোবর ও হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা থেকে জৈব সার উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৮০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। যা অনেক বেশি বাড়ানো যায়। এ দেশের মানুষের আছে উদ্যম, আছে উচ্ছ্বাস, আছে স্বপ্ন, আছে অভিলাষ, আছে রক্ত দিয়ে বিজয় অর্জনের ইতিহাস। সামান্য পৃষ্ঠপোষকতা, উদ্বুদ্ধকরণ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ করে বিপুল সম্ভাবনাময় পশুসম্পদ খাতকে কাজে লাগিয়ে এ দেশে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। এতে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংগ্রামে অবদান রাখতে সক্ষম হবো আমরাই।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ, রূপসা কলেজ।

এসইউ/এমএস

Read Entire Article