‘পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় যশোর হতে পারে তৃতীয় বাণিজ্যিক নগরী’

4 hours ago 4

যশোরের বেনাপোল দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর। এই বন্দরের সঙ্গে আরও চারটি বন্দর রয়েছে যশোরকে ঘিরে। এই পাঁচটি বন্দরের (মোংলা, ভোমরা, বেনাপোল, দর্শনা বন্দর ও নওয়াপাড়া নৌবন্দর) কানেক্টিভিটি রয়েছে যশোরের সঙ্গে। পাশাপাশি যশোরে একটি ইপিজেড হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে যদি আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়, তাহলে যশোর হবে দেশের তৃতীয় বাণিজ্যিক নগরী। এমনই ভাবনা যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. মিজানুর রহমান খানের। যশোরের ব্যবসা বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি, সমস্যা-সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে।

জাগো নিউজ: যশোরে ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিস্থিতি কী?

মিজানুর রহমান খান: জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বেসরকারি ঋণ প্রবাহ প্রায় বন্ধের পথে; ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এক প্রকার আইসিইউতে রয়েছে। সার্বিকভাবে আমদানি কমে গেছে; রপ্তানি প্রবাহও কমে গেছে। বাংলাদেশে একমাত্র গার্মেন্টস শিল্প বাদে অন্যান্য যেসব পণ্য রপ্তানি হতো সেগুলোতে ভাটা পড়েছে। সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে গতি তা স্লথ অবস্থায় চলে গেছে। এখন সবাই দেশে একটি সুন্দর পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করছে এবং একটি রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত এই গতি বাড়বে বলে মনে করি না।

তিনি বলেন, বিনিয়োগ কখন আসে, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কখন পরিবর্তন হয়, উচ্চ দিকে যায়? যখন রাজনৈতিক অবস্থা সুন্দর থাকে, একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মানুষ নির্ভয়ে চলাফেরা করবে, সর্বোপরি একটি দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা আইনের শাসন সবমিলিয়ে যখন একটি সুন্দর অবস্থা থাকে তখন ব্যবসা বাণিজ্যের গতিও বৃদ্ধি পায়।

জাগো নিউজ: ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় চেম্বার অব কমার্স কী ধরনের কর্মকাণ্ড করছে?

মিজানুর রহমান খান: শুধু যশোর নয়, যশোর চেম্বার এই অঞ্চলের দশ জেলার চেম্বার ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বড় বড় পরিকল্পনাগুলোও করেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের প্রত্যেকটি কাজে যশোর চেম্বার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। ব্যবসায়ীদের যে হয়রানি- ভ্যাট-ট্যাক্স-ইনকাম ট্যাক্স নিয়ে যে জটিলতা হয়, আমরা সেগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা করে উভয়পক্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করি। চেম্বার উভয়পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে।

আরও পড়ুন-
‘উদ্যোক্তাদের বৈষম্যহীন ঋণ দিলে জেলায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়বে’
‘সম্ভাবনা থাকলেও বর্তমানে ব্যবসা স্থবির চুয়াডাঙ্গায়’
‘আম-চিংড়ির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে দরকার প্রসেসিং জোন’

পাশাপাশি যশোরে ইপিজেড হচ্ছে। চেম্বার থেকে আমরা এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধ করছি- আপনারা আসেন, এখানে ইন্ডাস্ট্রি করেন। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হোক, শিল্পের বিকাশ ঘটুক। নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হোক। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটুক। এ বিষয়ে যশোর চেম্বার সবসময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ: দীর্ঘদিন নির্বাচিত কমিটি না থাকায় চেম্বারের কর্মকাণ্ডে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?

মিজানুর রহমান খান: আমি সর্বশেষ সভাপতি ছিলাম। ২০১৪ সালের পর নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত এই চেম্বারে কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিল না। ডিসেম্বরের ১ তারিখে দায়িত্ব নিয়েছি। সবকাজ প্রশাসকের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। সাধারণত প্রশাসক যিনি থাকেন, তিনি সরকারি কাজে ব্যস্ত থাকার পর অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই দায়িত্ব পালন করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধরুণ আজ এক ব্যক্তি পণ্য রপ্তানি করবেন, বেনাপোল বন্দরে তার পণ্য প্রস্তুত রয়েছে। আজ রাতে তার দরকার ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ সনদ। প্রশাসকের কিন্তু এত দায় নেই। সুতরাং ওই ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ নিতে গেলে দুই-তিনদিন সময় লেগে যায়। ওই ব্যবসায়ীর কিন্তু ট্রাকগুলো বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকে এবং তাকে ড্যামারেজ দিতে হয়। এই একটি নয়, এমন অসংখ্য অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় ব্যবসায়ীদের। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্যান্য সমস্যাগুলো কার কাছে এসে বলবে, তার ব্যবসায়ীক প্রতিনিধি কে? অতএব গত দশ বছর এখানে ব্যবসায়ীরা অভিভাবকহীন অবস্থায় পড়ে ছিল।

জাগো নিউজ: যশোরে শিল্প বিস্তারে চেম্বারের কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে?

মিজানুর রহমান খান: ২০১১ সালে আমি প্রথম নির্বাচিত হই এবং ২০১৪ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলাম। কিন্তু এরপর আমরা চেম্বারে দায়িত্বে না থাকার পরও দায়িত্ববোধ থেকে এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধকরণ, শিল্পের বিকাশ, নতুন শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশের জন্য কাজ করেছি। এই অঞ্চলের লাইট-ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প সারাদেশের মধ্যে ভালো অবস্থানে রয়েছে। অটোমোবাইল শিল্প ভালো অবস্থানে রয়েছে। মোটর-পার্টস শিল্প ভালো অবস্থানে রয়েছে। সবমিলিয়ে আমাদের এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থা যাতে আরও বৃদ্ধি পায়, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়, সে ব্যাপারে আমরা সবসময়ই কাজ করছি। চেম্বারে না থাকলেও আমরা বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে কাজ করেছি।

‘পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় যশোর হবে তৃতীয় বাণিজ্যিক নগরী’

জাগো নিউজ: বেনাপোল স্থলবন্দর ও নওয়াপাড়া নৌ-বন্দর নিয়ে চেম্বারের ভাবনা-পরিকল্পনা কী?

মিজানুর রহমান খান: যশোর এমন একটি ভৌগোলিক জায়গায় অবস্থান করছে- মোংলা বন্দরের কানেক্টিভিটি বাই রেললাইন যশোরের সঙ্গে আছে, ভারতের সঙ্গে বেনাপোল বন্দরের রেললাইনের কানেক্টিভিটি আছে, এখানে ভোমরা বন্দর আছে, দর্শনা বন্দর আছে এবং নওয়াপাড়া নৌবন্দর আছে। এই পাঁচ বন্দরকে যদি কানেক্টিভিটির মধ্যে নেওয়া হয়, এখানে সড়ক যোগাযোগ বিদ্যমান রয়েছে, রেলপথ রয়েছে, বিমানপথ আছে, নদীপথও আছে। এত বড় অবকাঠামোগত সুবিধা এবং পাঁচটি বন্দরের কানেক্টিভিটি রয়েছে। আমরা বারবার বলছি, এখানে একটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের জন্য। এর সুবিধা হলো- বেনাপোল বা ভারত কিংবা মোংলা বন্দর হোক; এর সঙ্গে বহির্বিশ্বের আমদানি বা রপ্তানির কন্টেইনারগুলো এখানে আসবে। উৎপাদনের কাঁচামাল এখানে আসবে, আবার পরিপূর্ণ রপ্তানি পণ্য এখান থেকে কন্টেইনারে চলে যাবে। এছাড়া বাণিজ্যিক যে পণ্যগুলো আসবে, এখান থেকে সড়ক পথ, রেলপথ, নৌপথের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে। এতে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক শ্রী বৃদ্ধি হবে, কর্মসংস্থান হবে এবং ব্যবসায়ীদের সময় কম লাগবে, খরচও কমবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

জাগো নিউজ: যশোরে ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারে প্রতিবন্ধকতা, সংকট কী এবং নিরসনের ভাবনা সম্পর্কে বলুন।

মিজানুর রহমান খান: যশোরের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতা বলতে প্রথমেই যেটি বলতে হয়- যদি নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হতে চায়, তার সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে উৎসাহে বাধা। একজন উদ্যোক্তা যদি বিনিয়োগ করতে চান, তাকে প্রথমেই দশ-বারোটা সার্টিফিকেট নিতে হয়। এই সার্টিফিকেট নিতে গেলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছয় মাস-একবছরও চলে যায়। এতে একজন উদ্যোক্তা এসময় তার উদ্যোগের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ আশা হারিয়ে ফেলেন। এছাড়া এখানকার সড়কের যে বেহাল অবস্থা, এর উত্তরণ ঘটাতে হবে, প্রয়োজনে নতুন তৈরি করতে হবে। এখানে ইপিজেড হচ্ছে। নওয়াপাড়া নদীবন্দর ড্রেজিং করার মাধ্যমে বড় বড় জাহাজগুলো আনতে হবে। এগুলো যদি আমরা করতে পারি, তাহলে আমাদের অঞ্চলে ক্ষুদ্র-মাঝারি এবং বৃহৎ শিল্প তৈরি হওয়ার অবকাশ রয়েছে। এটা খুবই সম্ভব। আমরা মনে করি, এগুলো মিলিয়ে আমরা যদি আগামী পাঁচ বছরের জন্য পরিকল্পনা নিতে পারি, সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে যশোর হবে তৃতীয় বাণিজ্যিক নগরী।

জাগো নিউজ: যশোরের ইপিজেডকে অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর করতে এবং ব্যবসায়ীদের উদ্বুদ্ধ করতে চেম্বার কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে।

মিজানুর রহমান খান: দেশের গার্মেন্টস শিল্পের কথা যদি বলা হয়, ৮০ ভাগ গার্মেন্টস রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জে। সরকারও কিন্তু এগুলোকে বিভিন্ন এলাকায় সরিয়ে দিতে চাচ্ছে। যশোরে চৌগাছায় ডিভাইন গ্রুপ সাহস করে গার্মেন্টস স্থাপন করেছে, এখান থেকেই সরাসরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত যেসব গার্মেন্টস (ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে) সরিয়ে নিতে চায়, সেগুলোকে এই ইপিজেডে নিয়ে আসা; পাশাপাশি এই অঞ্চলের যারা শিল্পোদ্যোক্তা, তাদেরও উচিত এখানে রপ্তানিমুখী পণ্যের শিল্প-কারখানা স্থাপন করা। তাহলে এই ইপিজেডে শতভাগ রপ্তানিমুখী পণ্য তৈরি হবে এবং এই ইপিজেডকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া সম্ভব হবে।

জাগো নিউজ: যশোরের ব্যবসায়ীদের যেসব দাবি-দাওয়া পূরণ জরুরি, সেগুলো সম্পর্কে বলুন।

মিজানুর রহমান খান: সরকারের কাছে দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই আমরা বলতে চাই, একজন উদ্যোক্তার শিল্প স্থাপন করতে গেলে পূর্ণাঙ্গ পুঁজি থাকে না। যদি প্রকল্পে একশ টাকা প্রয়োজন হয়, উদ্যোক্তার থাকে ত্রিশ টাকা। ফলে বাকি ৭০ টাকার জন্য সরকারকে বেসরকারি ঋণ প্রবাহের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, উদ্যোক্তার যে আটটি-দশটি সনদ লাগে, এই সনদগুলো পাওয়ার জন্য ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে। কোনো উদ্যোক্তা যদি উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সরকার যদি জানতে পারে, তাহলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো উদ্যোক্তার ঘরে গিয়ে, তাদের দপ্তরে গিয়ে পরিদর্শন করে তাদের উৎসাহিত করার জন্য সাতদিনের মধ্যে এই সার্টিফিকেটগুলো দেওয়া উচিত। আমরা মনে করি এই দুটি পার্ট যদি সরকার সম্পন্ন করতে পারে তাহলে বিনিয়োগ এবং উদ্যোক্তা কীভাবে এগিয়ে আসবে, সেটা কল্পনার বাইরে।

এফএ/জেআইএম

Read Entire Article