পুরোনো ছকেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ

2 months ago 7

মূল্যস্ফীতি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাসহ বিভিন্ন সংকটে যখন দেশের অর্থনীতিতে টানাপোড়েন চলছে তখন আগের মতো ‘অবাস্তব’ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে।

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ২ জুন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন।

বাজেট বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি এবং বাকি ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে অন্যান্য উৎস থেকে।

বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না এনবিআর। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য এনবিআরকে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের মাঝপথে এসে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি করা হয়। চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আহরণ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

‘রাজস্ব আদায় কখনোই প্রক্ষেপণ অনুযায়ী হয় না। সব সময় রাজস্ব আদায় একই ধারায় রয়েছে। এবারও উচ্চ আকাঙ্ক্ষার রাজস্ব আহরণ বাজেটের বড় চিন্তার বিষয়। ১০ বছর ধরেই আমরা দেখছি, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না।’ -সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন

লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে

স্বাভাবিক স্থিতিশীল পরিস্থিতিতেও এই উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আহরণ কঠিন হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, বাজেটে করজাল বাড়ানোর ঘোষণা থাকলেও আদতে করভার বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা করা হয়েছে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন উত্তরণ, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে করভার বাড়িয়ে করজাল বাড়ানোর ঘোষণা, রিটার্ন জমা শিথিলকরণসহ বাজেটে নেওয়া নানান পদক্ষেপ রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার অর্জনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।

আরও পড়ুন

বাজেট নিয়ে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘রাজস্ব আদায় কখনোই প্রক্ষেপণ অনুযায়ী হয় না। সব সময় রাজস্ব আদায় একই ধারায় রয়েছে। এবারও উচ্চ আকাঙ্ক্ষার রাজস্ব আহরণ বাজেটের বড় চিন্তার বিষয়। ১০ বছর ধরেই আমরা দেখছি, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না।’

ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজস্ব আহরণ বাড়াতে না পারলে ঘাটতি বেড়েই যাবে। রাজস্ব আদায় সেভাবে না হওয়ায় এবার বাজেট ঘাটতি কমানো হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, বাজেট মূলত আগের বছরের কাঠামো অনুসরণ করেছে। দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলোর প্রতি তেমন গুরুত্ব না দিয়ে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের অভাব রয়ে গেছে। দীর্ঘদিনের অসঙ্গতি—দুর্বল রাজস্ব আহরণ, অদক্ষ সরকারি ব্যয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা গভীরভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।

বাজেটে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা এক কথায় অর্জন করা অসম্ভব। স্বাভাবিক সময়েও রাজস্ব আহরণের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়। - বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেটে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা এক কথায় অর্জন করা অসম্ভব। স্বাভাবিক সময়েও রাজস্ব আহরণের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়।

চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি কেমন

চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের ১১ মাস পেরিয়ে গেছে। আলোচ্য সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। সরকারের দেওয়া সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে এক মাসে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৪২ হাজার ৫০ কোটি টাকা, যা অসম্ভব বলে জানিয়েছেন এনবিআর সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে।

চলতি অর্থবছরও যে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে আছে, সে কথা তুলে ধরে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত মার্চ পর্যন্ত আদায়ের যে ধারা, তা বজায় থাকলে অর্থবছরের শেষ দুই মাসে এক লাখ কোটি টাকা আদায় বাড়াতে হবে, যা নিয়ে সংশয় আছে।

মধ্য ও নিম্নবিত্তের চাপ বাড়বে

বাজেটে অর্থ উপদেষ্টা কর বাড়াতে সাধারণ মানুষের জন্য আয়করে ছাড় দেননি। মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা রেখেছেন। যদিও ভবিষ্যতের রূপরেখা দিয়েছেন। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে এই সীমা প্রযোজ্য হবে।

বাজেটে করহার না বাড়ানো হলেও অনেক নিত্যপণ্যের ওপর করভার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। যার প্রভাব পড়বে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে।

আবার চাল, ডালসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎসে কর কমানো হয়েছে। চিনি, তেল উৎপাদনে কর ছাড় দেওয়া হয়েছ। এসব উদ্যোগে সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবে।

লিপস্টিক থেকে শুরু করে প্লাস্টিক পণ্য, মোবাইল ফোন, এলপিজি সিলিন্ডার, ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ, এসিসহ একাধিক পণ্যে করভার বাড়ানো হয়েছে। এসব পণ্য কিনতে বেশি টাকা গুনতে হবে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষদের।

আবার সর্বনিম্ন আয়কর এলাকাভেদে ৫ হাজার, ৪ হাজার ও ৩ হাজার টাকা থাকলেও বাজেটে এটিকে সব এলাকার জন্য ৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। ফলে মধ্যবিত্তের করের বোঝা বাড়ছে।

বিত্তশালীদের ছাড়

অর্থ উপদেষ্টা বিত্তশালীদের ছাড় দিয়েছেন। সারচার্জের হিসাব পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে বিত্তশালীদের কর ভার কমবে।

যদিও গত মঙ্গলবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এবারের বাজেট মানুষের বাজেট। মানুষের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সীমিত সম্পদের মধ্যে এ বাজেট করা হয়েছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, কর কাঠামো বিন্যাস করতে গিয়ে ছয়টি শ্রেণি করা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, নিম্নবিত্ত মানুষের করহার বেশি হবে, কিন্তু উচ্চবিত্তদের কম পড়বে। এটা বৈষম্যমূলক।

এসএম/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম

Read Entire Article