পুরোহিতের বাড়ি ভাঙচুর-লুটপাট ও জমি দখলের অভিযোগ
ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে এক হিন্দু পুরোহিতের বসতবাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর ও লুটপাটসহ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী।
মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) আশুলিয়া থানায় মামলাটি করেন ভুক্তভোগী সন্তোষ ভট্টাচাৰ্য্য।
অভিযুক্তরা হলেন- মো. জাহাঙ্গীর আলম (৬২), মো. মনির হোসেন (৬৫), মো. সানোয়ার হোসেন (৫৫), মো. সাইফুল ইসলাম (৫০), শামিম হোসেন ওরফে বাবু (৩০), মো. রকি (৩৫), মো. জুয়েল (৩০), কানন বালা সরকার (৫০), দিপক মন্ডল (২৫), দিলিপ মণ্ডলসহ (২০) অজ্ঞাত ৪-৫ জন। তারা সবাই সাভারের আশুলিয়ার মির্জানগর এলাকার বাসিন্দা।
ভুক্তভোগী সন্তোষ ভট্টাচাৰ্য্য (৭৩) একই এলাকার বাসিন্দা। তিনি পেশায় পুরোহিত।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ভুক্তভোগী আশুলিয়ার বাঁশবাড়ী মৌজায় সিএস ও এসএ নং-৫২৫, ৫২৬, আরএস নং-৬২৫, ৬২৬ দাগে ৪৩ শতাংশ জমিতে মালিকানাধীন সূত্রে বাড়ি করে বসবাস করছেন। অভিযুক্তরা দীর্ঘদিন ধরে তার বাড়ি ও সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করছে। এরই জেরে গত ১২ ডিসেম্বর দেশীয় অস্ত্রসহ তারা ভুক্তভোগীর বাড়িতে হামলা করে। এসময় তার গোয়ালঘর ভাঙচুর করে ও বাড়ি থেকে ১ লাখ ২০ হাজার নগদ টাকা ও প্রায় ১ লাখ টাকা মূল্যমানের গাছ কেটে নেয়। এতে সব মিলিয়ে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সময় তারা ভুক্তভোগীর ঘর ভাঙচুর করে ও তাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের হুমকি দেয়। এ ঘটনার জেরে আতঙ্কে দিন পার করছে পরিবারটি।
নথি ও ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, সিএস-১৫৬ নম্বর খতিয়ান ও এসএ-২৪০ নম্বর খতিয়ানে ৫২৫, ৫২৬, ৪১, ১১৯ দাগ ও আরএস ৬২৫, ৬২৬, ৬৭, ১১৬ দাগে মোট জমির পরিমাণ ১৪৩ শতাংশ।
সিএস খতিয়ানে এই জমির মালিক ও দখলকার ছিলেন সারদা দেবী। পরবর্তীতে তিনি একমাত্র কন্যা কৈলাস কামিনী দেব্যাকে রেখে মারা যান। এরই ধারাবাহিকতায় এসএ খতিয়ানে কৈলাস কামিনী দেব্যার নামে ২৪০ নম্বর খতিয়ানে সব দাগের জমি রেকর্ডভুক্ত হয়। এর মধ্যে সিএস ১৬০ দাগ ও এসএ ৬০ দাগ থেকে ৬০ শতাংশ জমি বিক্রি করেন কৈলাস কামিনী দেব্যা। পরবর্তীতে তিনি ১৯৬৯ সালের ৩ জুলাই ৪৮৭৬ নম্বর দলিলে তার সব সম্পত্তি আকালী কুমার চক্রবর্তীকে দানপত্র করে দখল বুঝিয়ে দেন। সে সময় থেকে জমিগুলোতে ভোগদখলে রয়েছেন আকালী কুমার চক্রবর্তীর পরিবারের সদস্যরা। বর্তমানে তার তিন সন্তান সন্তোষ ভট্টাচার্য, ক্ষিতীশ ভট্টাচার্য ও রতিশ ভট্টাচার্য এসব জমিতে দখলদার রয়েছেন।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীর আলমের নথি ও তার দাবি মতে, সিএস মালিক ছিলেন সারদা দেবী। পরে তার মেয়ে কৈলাস দেব্যা এ জমির মালিক হন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। এ কারণে দত্তক নেন তার ভাসুরের ছেলে অমূল্য চন্দ্র চক্রবর্তীকে। এই অমূল্য চন্দ্র চক্রবর্তীর দুই ছেলে শ্রী দুলাল চন্দ্র চক্রবর্তী ও শ্রী সুভাস চন্দ্র চক্রবর্তীর কাছ থেকে জাহাঙ্গীর আলম ১১৭ শতাংশ জমি কিনে নেন।
নথি বলছে, শ্রী অমূল্য চন্দ্র চক্রবর্তী ১৯৮৩ সালের ৪৫৫/৮২ নম্বর নামজারিতে প্রথম জমিটিতে ৫২৪ নম্বর জোত নম্বরে ৫২৫ ও ৫২৬ নম্বর দাগে নামজারি মূলে মালিক হন। সেখান থেকেই জাহাঙ্গীর আলম ১১৭ শতাংশ জমি কিনে নেন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সাল থেকে কয়েক দফায় কছিম উদ্দিনের সঙ্গে এই জমি বিক্রি ও পুনরায় গ্রহণ করেন এবং সে অনুযায়ী নামজারি করান। এভাবেই জাহাঙ্গীর আলম এসব জমিতে নিজের নামজারি মালিকানা গ্রহণ করেন।
যদিও ভুক্তভোগী সন্তোষ ভট্টাচার্য্যের দাবি, শ্রী অমূল্য চন্দ্র চক্রবর্তী নামে তার কিংবা কৈলাস কামিনী দেব্যার কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না। মূলত ভুয়াভাবে কাগজ বানিয়ে এই মালিককে দেখানো হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম কিংবা শ্রী অমূল্য চন্দ্র চক্রবর্তী কেউই ১৯৮৩ সালের আগে কোনো দিন কোনো দাবি নিয়ে আসেননি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কৈলাস কামিনী দেব্যা আমৃত্যু আকালী কুমার চক্রবর্তীর পরিবারের কাছেই ছিলেন।
এদিকে আরএস রেকর্ড সংশোধনের আর্জি জানিয়ে সন্তোষ ভট্টাচাৰ্য্য ঢাকার ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেছেন। তিনি বলছেন, এই মামলা নিষ্পত্তি হলেই আরএস ও বিএস -এ তিনি মালিকানা পাবেন। তার পূর্বসূরিরা অন্তত ১৯০০ সালের শুরু থেকে জমির মালিকানাধীন। আর বিবাদি যে মালিকানা দাবি করছেন ও রেকর্ডভুক্ত হয়েছেন সেটি মূলত কৈলাস কামিনী দেব্যা জীবিত থাকাকালে যে ৬০ শতাংশ জমি বিক্রি করেছিলেন, সেখান থেকে।
সন্তোষ ভট্টাচাৰ্য্য বলেন, আমার কর্তা (কৈলাস কামিনী দেব্যা), আমার বাবা ও এখন আমার ভাইরা জমি ভোগদখল করছি। তারা জোর করে এই জমি দাবি করছে। আর এত বছর দখলে আসার চেষ্টা করেনি। গত ৫ আগস্টের পর তারা জমি দাবি করছে।
এদিকে হামলার জেরে আতঙ্কিত পরিবারটি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুরোহিতের বসতবাড়ির পাশে উঠানে জমি দখল করে বালু ভরাট করা হয়েছে। এছাড়া সেখানে রাতারাতি টিনের একটি ছোট্ট কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যদিকে পুরোহিতের বসতবাড়িতে দেখা মেলে ভাঙচুরের প্রমাণ।
সন্তোষ ভট্টাচার্যের মেয়ে জোসনা চক্রবর্তী বলেন, জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে আমাদের জায়গা দখল করা হয়েছে। জাহাঙ্গীর বিভিন্ন সময় ভাড়া করা লোকজন নিয়ে এসে আমাদের হুমকি দেয়। আমার ভাই চাকরি করে, আমার কাকা চাকরি করে, বাড়িতে আমরা মহিলারা একাই থাকি। জাহাঙ্গীরের ভয়ে আমরা সবসময় আতঙ্কে থাকি। আমাদের জায়গা অথচ বিএস করার সময় তারা জোরপূর্বক আমাদের বিএস করতেও দেয়নি। আমরা আমাদের জায়গা ফেরত চাই। আমরা সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা চাই।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আমি কারো গাছপালা কাটিনি, কারো গোয়ালঘরও ভাঙ্গিনি। কাউকে কোনো হুমকি-ধমকিও দেইনি। আমি এই জায়গাটিতে দুই মাস আগে বালু ফেলেছি। কাগজে কলমে এটি আমার জায়গা। সন্তোষ ভট্টাচার্য তার এক পুলিশ আত্মীয়ের সহযোগিতায় প্রভাব খাটাচ্ছে। আমার জায়গায় যেসব বেড়া দিয়েছিলাম সেগুলো ভেঙেছে আমার সাইনবোর্ডও ভেঙে ফেলেছে। এই জায়গাটি আমি ১৯৮৫ সালে কিনেছি। আমি কারো জায়গা দখল করিনি। এই জায়গার খাজনা-খারিজ সব আমার নামে হালনাগাদ করা আছে। তাদের কোনো খাজনা-খারিজও নাই। তারা বিভিন্ন ভুয়া দলিল করে এখন এই জায়গার মালিক দাবি করছে। আপনারা আমার কাগজপত্র ও তার কাগজপত্র দেখেন। যদি আমার কাগজপত্র ঠিক না থাকে তাহলে আমি এখান থেকে সম্মানের সঙ্গে চলে যাবো।
এসব বিষয়ে আশুলিয়া থানার ওসি নুরে আলম সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।