জেলার পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) দেওয়া এবং পুলিশের সার্বিক কার্যক্রম মূল্যায়নের দায়িত্ব চান জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)।
একই সঙ্গে ডিসিদের অধীনে বিশেষ ফোর্স গঠন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক আনসার নিয়োগসহ এরই মধ্যে তিন শতাধিক প্রস্তাব দিয়েছেন জেলা প্রশাসকরা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আয়োজনে আগামী ১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক বা ডিসি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের নীতিনির্ধারক এবং জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের মধ্যে সামনা-সামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেওয়ার জন্য সাধারণত প্রতি বছর ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সম্মেলনের আগেই ডিসিরা মাঠ পর্যায়ের সমস্যাগুলো সমাধান ও চ্যালেঞ্জ উত্তরণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠান। অধিবেশনের সময় এগুলো ছাড়াও ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনাররা তাৎক্ষণিক বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন। এ প্রস্তাবগুলো নিয়ে সম্মেলনে কার্য-অধিবেশনগুলোতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে আলোচনা হয়। আলোচনার পর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যে প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য মনে করবে সেগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখা) মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হবে তিনদিনের ডিসি সম্মেলন। কার্য-অধিবেশনগুলো ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সম্মেলন উপলক্ষে আমরা এখনও ডিসিদের কাছ থেকে প্রস্তাব পাচ্ছি। কত প্রস্তাব হয়েছে তা এখনই চূড়ান্তভাবে বলা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত মোটামুটি তিন শতাধিক প্রস্তাব এসেছে।’
ডিসিদের পাঠানো প্রস্তাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন সাতক্ষীরার ডিসি। এর স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে ডিসি বলেন, জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রকৃতপক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কোনো দাপ্তরিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন ডিসি ও ইউএনওদের নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন।
এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের সুপারিশে সাতক্ষীরার ডিসি মোস্তাক আহমেদ বলেন, প্রতি মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পারফরম্যান্স সংক্রান্ত একটি গোপনীয় প্রতিবেদন ডিসি ও ইউএনওর কাছ থেকে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। পুলিশ সুপার ও থানার ওসির (অফিসার ইনচার্জ) বার্ষিক গোপনীয় অনুমোদনকারী কর্মকর্তা হিসেবে যথাক্রমে ডিসি ও ইউএনওকে মনোনয়ন করা যেতে পারে।
প্রায় একই রকম প্রস্তাব দিয়েছেন গাইবান্ধার ডিসি চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমদ। তিনি প্রস্তাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে পুলিশের সার্বিক কার্যক্রমের ওপর বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য তিনি দায়িত্বশীল ও তাকে জবাবদিহি করতে হয়। জেলা পুলিশের কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে এবং জনকল্যাণমূলক পুলিশ বাহিনী বাস্তবায়নে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে তাদের মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ‘পুলিশ রেগুলেশন্স অব বেঙ্গল, ১৯৪৩’ এর ৭৫/এ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করে এ বিধান চালুর প্রস্তাব দেন তিনি।
মাগুরার ডিসি মো. অহিদুল ইসলাম প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকের অধীনে একটি স্পেশাল ডেডিকেটেড রেসপন্স ফোর্স গঠনের প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজে কিংবা তার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট, উচ্ছেদ অভিযানসহ বিভিন্ন জরুরি কার্যক্রম তথা ত্রাণ বিতরণ, দুর্যোগে তাৎক্ষণিক সেবা দেন, যা প্রায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। নিজস্ব সুরক্ষা ও এ ধরনের জরুরি সেবা কার্যক্রম বেগবান করার জন্য জেলা প্রশাসকের অধীনে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে একটি স্পেশাল ডেডিকেটেড রেসপন্স ফোর্স স্থায়ীভাবে নিয়োগ করা প্রয়োজন। এ ধরনের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে বিদ্যমান বিভিন্ন বাহিনীর সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে দূরত্ব বা প্রস্তুতিমূলক কারণে সময়ক্ষেপণ হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সরকারি স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। তাই ডিসির অধীনে ১০-১৫ জনের বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে একটি স্পেশাল ডেডিকেটেড রেসপন্স ফোর্স গঠন করা যেতে পারে বলে প্রস্তাবে জানিয়েছেন মাগুরার ডিসি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তব্যরত অবস্থায় বাধ্যতামূলক বডি ক্যামেরা ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ।
একই সঙ্গে তিনি আরেক প্রস্তাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারণাস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাবের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে মাহবুব মুরাদ বলেন, জনবিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মারণাস্ত্র ও ছররাগুলি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় ছররাগুলি মানবদেহের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
জেলার জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (সার্কিট হাউজ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা দায়রা জজ আদালত, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের বাসভবন) কেপিআই নিরাপত্তায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন ঝিনাইদহের ডিসি মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল।
পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ কমিটিতে জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত, অপরাধ ডাটাবেজ ও ন্যাশনাল আইডি ডাটাবেজে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং ইউএনওদের এক্সেস প্রদান এবং ইউএনওর বাসভবন ও শারীরিক নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক ব্যাটালিয়ন আনসার নিয়োগের প্রস্তাব দেন তিনি।
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মানোয়ার হোসেন মোল্লাও পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ কমিটিতে ডিসির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
সমুদ্রে মৎস্য আহরণ করতে গিয়ে নিখোঁজ জেলেদের পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছেন বরগুনার ডিসি মোহাম্মদ শফিউল আলম।
টেঁটা যুদ্ধ দমন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নরসিংদীর ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে আলাদা থানা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন সেখানকার ডিসি মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী।
মাগুরার ডিসি ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইনের বিধিমালা তৈরিরও প্রস্তাব দিয়েছেন।
মুজিবনগরে স্থলবন্দর করার প্রস্তাব দিয়েছেন মেহেরপুরের ডিসি। রাঙ্গামাটির ডিসি জেলখানার বন্দিদের ঘুমানোর জন্য দ্বিতল শয্যাবিশিষ্ট স্টিলের খাটের ব্যবস্থা, বরিশালের ডিসি ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩’ এর ৬ ও ১৬ ধারা মোবাইল কোর্টে আইনে তফসিলে অন্তর্ভুক্তকরণ এবং মুন্সিগঞ্জের ডিসি নকল বা জাল ব্যান্ড রোল/স্ট্যাম্প ব্যবহার রোধে ‘দণ্ডবিধি-১৮৬০’ এর ২৫৫ থেকে ২৬৪ ধারা মোবাইল কোর্টের তফসিলভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
এবার ডিসি সম্মেলনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে ডিসিদের কার্য-অধিবেশন, এছাড়া একটি উদ্বোধন অনুষ্ঠান, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মুক্ত আলোচনা, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও একটি সমাপনী অনুষ্ঠান থাকবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানা গেছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে। কার্য-অধিবেশনগুলো গত বছরের মতো এবারও ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে হবে।
কার্য-অধিবেশনগুলোতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে উপদেষ্টা, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত থাকবেন। কার্য অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
আরএমএম/এমএমএআর/জিকেএস