পেয়ারার উৎপাদন কম, ভালো দামেও খুশি নন চাষিরা

1 month ago 10

ঝালকাঠির ৩৬ গ্রামে পেয়ারার উৎপাদন গত বছরের চেয়ে কম হয়েছে। উৎপাদন কম হলেও ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা। তবুও খুশি হতে পারেননি তারা। চাষিদের ভাষ্যমতে, এক বিঘা জমিতে পেয়ারা উৎপাদন হওয়ার কথা প্রতিদিন ১০ মণ। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে আড়াই থেকে তিন মণ। যে কারণে দাম বেশি পেলেও কাঙ্ক্ষিত উপার্জন সম্ভব হচ্ছে না। আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস পাকা পেয়ারার মৌসুম।

জেলার সদর উপজেলার উত্তরদিকে অবস্থিত ভীমরুলী গ্রাম। গ্রামটিতে সবচেয়ে বড় মোকামে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার পেয়ারা বেচাকেনা হয়। সদর উপজেলার ১৩ গ্রামের ৩৫০ হেক্টর জমিতে পেয়ারা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। তাছাড়া আশপাশের ২৩টি গ্রামে আছে পেয়ারার চাষ। এসব গ্রামের কয়েক হাজার পরিবারের দিন বদল হয়েছে।

পেয়ারার উৎপাদন কম, ভালো দামেও খুশি নন চাষিরা

এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ হয়। জলে ভেসে ভেসে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় পণ্য নিয়ে বেচাকেনা চলে। বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা ট্রলার, ট্রাক, মিনিট্রাক ও পিকআপ নিয়ে এসে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে কেনা শেষ করে পেয়ারা আপলোড করে ছুটে চলেন গন্তব্যে। ভীমরুলী গ্রামের ভাসমান বাজারের প্রধান পণ্য পেয়ারা। সারি সারি নৌকার ওপর কাঁচা-পাকা সবুজ-হলুদ পেয়ারা। এর ভারেই নৌকাও ডুবেছে দুই-তৃতীয়াংশ। হাটুরেদের হাঁকডাকে গম গম পুরো এলাকা। এককথায় খালের ওপর এ এক অবাক করা বাজার।

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, এটি অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান হাট। ভীমরুলীর জলে ভাসা হাটে পেয়ারা বোঝাই ডিঙি নৌকাগুলো এপাশ-ওপাশ করে। ভালো দামের আশায় চাষিদের এমন নড়চড়। খালের দুপাশে ব্যবসায়ীদের আড়ৎ। তারাই কিনবেন। বাংলাদেশের সিংহভাগ পেয়ারা উৎপাদনকারী অঞ্চলের চাষিরা ডিঙিতে বসেই বেচাকেনায় মগ্ন। তাই দক্ষিণাঞ্চলের হাট-বাজার আর বাগান এলাকাজুড়ে পাকা পেয়ারার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। পাইকার এবং চাষিদের বেচাকেনার ধূম চলছে মোকামগুলোতে। পেয়ারাকে ভালোবেসে ‘বাংলার আপেল’ বা ‘গরিবের আপেল’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

এখানে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে পেয়ারা উৎপাদন হয়। তবে সংরক্ষণের অভাবে চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। পেয়ারাগুলো দ্রুত পেকে যায়। ফলে দ্রুত বিক্রি না করতে পারলে পড়তে হয় ক্ষতির মুখে। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ থাকলে বছরজুড়ে ভোক্তাদের চাহিদা মিটিয়ে চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হতেন। দীর্ঘদিনেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে না ওঠায়, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পেয়ারা চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই।

পেয়ারার উৎপাদন কম, ভালো দামেও খুশি নন চাষিরা

আরও জানা যায়, এবার ফাল্গুনে গাছে ফুল ধরে। কিন্তু অতিরিক্ত খরায় পানির অভাব দেখা দেয়। যে কারণে ফুল ঝরার পাশাপাশি অনেক গাছ মারা যায়। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চাষিরা গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত সার এবং মাটি দিতে পারেননি। সবমিলিয়ে উৎপাদন কম হলেও দাম ভালো ছিল। তবুও তাদের হতাশা কাটেনি। প্রতিদিন ১০ মণ পেয়ারা নামার কথা থাকলেও ৩-৫ মণ নামছে। আকার ও মানভেদে ১ হাজার থেকে শুরু করে ১২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ।

ঝালকাঠির ভীমরুলী গ্রামের পেয়ারা চাষি ফণি ভূষণ দাস বলেন, ‘খরা এবং রোদের তাপের কারণে পেয়ারার মুকুল ও কচি পেয়ারা পুড়ে গেছে। এ কারণে এ বছর উৎপাদন কম। প্রতি বছরের চেয়ে দাম ভালো হলেও উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী উপার্জন করতে পারছি না।’

কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারা চাষি জাহিদ মিয়া বলেন, ‘আমাদের ভাগ্য ভালো, খরার কারণে ফলন ভালো না হওয়ার ভয় ছিল। ওপরওয়ালা সহায় থাকায় ফলন এবার তবুও যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। মৌসুমের শুরুতেই ২৫-৩০ টাকা কেজি দরে প্রতি মণ পেয়ারা ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে পেয়ারার দাম কমে গেছে। প্রতি মণ ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারছি।’

জগদীশপুর গ্রামের পেয়ারা চাষি বিমল মিস্ত্রি জানান, প্রতি বছর হিমাগারের অভাবে এসব এলাকার কয়েক কোটি টাকার পেয়ারা নষ্ট হয়ে যায়। কারণ পেয়ারা পচনশীল ফল। তাই দ্রুত পেকে যাওয়ায় তা সংরক্ষণ করে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই।

আড়তদার লিটন হালদার বলেন, ‘মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মণ পেয়ারা বিক্রি হয়। মোকাম থেকে সড়ক ও নৌপথে খুলনা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, পটুয়াখালী, ভোলা, মাদারীপুর, নাটোর ও বরিশালে হাজার হাজার মণ পেয়ারা যাচ্ছে। এলাকার প্রায় ৭-৮ হাজার শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।’

পেয়ারা চাষি বিশ্বজিৎ চৌধুরী জানান, সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে বড় সাইজের পেয়ারা প্রসেসিং করে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। হেক্টর প্রতি ৫-৬ মেট্রিক টন উৎপাদিত পেয়ারা থেকে বছরে প্রায় আড়াই থেকে ৩ কোটি টাকা আয় হয়।’

ঝালকাঠির জেলা প্রসাশক আশরাফুর রহমান জানান, সংরক্ষণসহ কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা গড়ে উঠলে চাষিরা আর্থিকভাবে লাভবান হতেন। যুগ যুগ ধরে পেয়ারা চাষাবাদ করে এলেও উদ্যোক্তার অভাবে হিমাগারসহ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে না ওঠায় দিন দিন চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষিরা।

আতিকুর রহমান/এসইউ/জিকেএস

Read Entire Article