প্রকল্প পরিচালক হওয়া লক্ষ্য হয়ে উঠেছে অনেক কর্মকর্তার

3 hours ago 5

দেশের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অতিমাত্রায় প্রকল্পনির্ভর সংস্কৃতির কারণে সংস্থাটি তাদের মূল কাজ—নিয়মিত ও নিরপেক্ষ পরিসংখ্যান প্রণয়ন থেকে অনেকটাই বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এ ‘প্রকল্প সংস্কৃতি’ মূল দায়িত্ব থেকে সংস্থার মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছে। ফলে মাঠপর্যায়ের জরিপ যেমন দুর্বল হয়েছে, পাশাপাশি তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত এবং সদরদপ্তরকেন্দ্রিক কাজের প্রবণতা বেড়েছে।

এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব, জটিল আমলাতন্ত্র ও দাতানির্ভরতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি তথ্যের মান ও বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না। প্রকল্প পরিচালক হওয়া অনেক কর্মকর্তার ক্যারিয়ারের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। বিবিএস সংস্কারের জন্য গঠিত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সোমবার (২০ অক্টোবর) পরিসংখ্যান দিবস উপলক্ষে বিবিএস আয়োজিত অনুষ্ঠানে টাস্কফোর্সের এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। গত ২৮ এপ্রিল আট সদস্যের একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। যার দায়িত্ব ছিল বিবিএসের মান, স্বচ্ছতা, জরিপ পদ্ধতি ও সাংগঠনিক সক্ষমতা পর্যালোচনা করে সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশ করা।

আট সদস্যের এ টাস্কফোর্সের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।

আরও পড়ুন
অতিমাত্রায় প্রকল্পনির্ভরতা বিবিএসকে মূল কাজ থেকে বিচ্যুত করেছে

টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬-০৭ অর্থবছরের দিকে তহবিল অনিশ্চয়তার কারণে বিবিএসকে দাতানির্ভর হতে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই নির্ভরতা প্রকল্প সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। এই সংস্কৃতি ‘ডেটা সাইলো’ তৈরি করেছে, বহিরাগতভাবে চাপানো পদ্ধতি চালু করেছে এবং ব্যুরোর বাজেট ব্যবস্থায় অদক্ষতা ও অপচয় বাড়িয়েছে।

এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বিবিএস এমন এক প্রকল্পনির্ভর সংস্কৃতির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতিশক্তি দুর্বল করেছে, অস্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করেছে এবং সদরদপ্তরকেন্দ্রিক কর্মপদ্ধতির ফলে মাঠপর্যায়ে দুর্বলতা তৈরি করেছে।

প্রকল্প সংস্কৃতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির সদরদপ্তরে ভিড়কে উৎসাহিত করা হচ্ছে, যার ফলে তথ্যের উপস্থিতিতে ফাঁক তৈরি হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতিশক্তি দুর্বল হচ্ছে এবং অপচয়মূলক ও অদক্ষ বাজেট প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।

প্রতিবেদন বলছে, একটি উল্লেখযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক গতিশীলতা আবির্ভূত হয়েছে, যেখানে প্রকল্প পরিচালক বা উপ-প্রকল্প পরিচালকের পদ অনেক কর্মকর্তার জন্য একটি অত্যন্ত চাওয়া-পাওয়ার বিষয় বা ক্যারিয়ারের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

প্রতিবেদনে টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, বিবিএসকে একটি আধুনিক, পেশাদার ও স্বাধীন জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থায় রূপান্তরিত করতে হলে প্রকল্পনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে স্থায়ী কাঠামো ও নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিবিএস রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারি পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এমন তথ্য প্রকাশে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রভাব পড়ছে। রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা, জটিল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এবং বহিরাগত অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা বিবিএসের ডেটা প্রকাশের সংস্কৃতি বিলম্বিত ও বিকৃত করেছে। একই সঙ্গে নির্ভরযোগ্যতা ও সময়োপযোগিতা ব্যাহত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ টাস্কফোর্সের মতে, প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্থায়ী চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো এর তথ্য প্রকাশ প্রক্রিয়ায় বহিরাগত হস্তক্ষেপ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান তৈরি ও প্রচারের আদেশ থাকা সত্ত্বেও মূল প্রতিবেদনের সময় স্বাধীনতা, গুণমান, স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে প্রায়শই রাজনৈতিক চাপের কারণে আপস করেছে সংস্থাটি। তথ্য প্রকাশে শুধু রাজনৈতিক চাপই নয়, বরং প্রায়শই রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা, দাতাদের নির্ভরতা এবং আমলাতান্ত্রিক তত্ত্বাবধানের কারণেও আপস করা হয়েছে। এ সমস্যাগুলো শুধু জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করে না, বরং পরিসংখ্যানগত ফলাফলের নীতিগত প্রাসঙ্গিকতাও কমিয়ে দেয়।

টাস্কফোর্স বলেছে, একটি বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা (এনএসও) আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার মূলভিত্তি। এটি সরকারের প্রমাণভিত্তিক নীতিনির্ধারণ, জবাবদিহি, সম্পদের কার্যকর বরাদ্দ ও সামাজিক আলোচনা সচল রাখতে সহায়তা করে। সরকারি পরিসংখ্যানের ওপর আস্থা তখনই তৈরি হবে, যখন তা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে পেশাদার ও স্বচ্ছভাবে তৈরি হবে।

টাস্কফোর্সের চূড়ান্ত সুপারিশে বলা হয়েছে, পরিকল্পনা উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি টাস্ক টিম গঠন করা হোক, যারা প্রতিবেদন বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ ও গতিশীল করবে।

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আমরা আশা করি, এই বিশ্লেষণ ও সুপারিশগুলো বিবিএসকে একটি সত্যিকারের শক্তিশালী ও স্বাধীন পরিসংখ্যান সংস্থায় পরিণত করবে, যা রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়েরই কল্যাণে কাজ করবে।

বিবিএস সংস্কারে কাজ ও অর্থ খরচের স্বাধীনতাসহ অগ্রাধিকারমূলক ৭টি সুপারিশ তুলে ধরেছে এ বিষয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ টাস্কফোর্স। প্রশাসন ক্যাডারের পরিবর্তে পেশাদার কাউকে বিবিএসের নেতৃত্বে আনার সুপারিশও করা হয়েছে।

সুপারিশগুলো হলো—গুণগত মান নিশ্চিতে সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো; মানসম্পন্ন মানবসম্পদ ও নেতৃত্ব তৈরি; কার্যকর ডেটা ইকোসিস্টেম ও মৌলিক অবকাঠামো গড়ে তোলা; অংশীজনদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; শক্তিশালী পরিচালন কাঠামো গঠন; বিবিএসের বাজেট স্বায়ত্তশাসন ও আর্থিক স্বাধীনতা এবং মুক্ত তথ্য ও প্রকাশের নীতিমালা প্রণয়ন করে জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

কিছু সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান আইন বিবিএসকে একটি স্পষ্ট আইনি আদেশ প্রদান করে, যদিও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং ফাঁক রয়েছে। তবুও ডেটা-সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপেশাদার অনুমোদন কাঠামোর ওপর নির্ভরতা, অনিশ্চিত তহবিলের বোঝা এবং এসআইডি ও বিবিএসের মধ্যে দায়িত্বের ত্রুটিপূর্ণ বণ্টনের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। পেশাদার স্বাধীনতার এ ফাঁকগুলো কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ একটি স্পষ্ট সংস্কার অগ্রাধিকার।

বিশ্বাসযোগ্য তথ্য উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব
এদিকে বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবসের সেমিনারে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বিশ্বাসযোগ্য সরকারি ডেটা উৎপাদন করতে হবে—এটি বিনিয়োগ। বিবিএসের তথ্য উন্মুক্ত থাকা উচিত। তথ্য লুকোচুরি বা কারসাজির কোনো প্রশ্নই আসে না, নতুন বিধিমালায় এ নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের আলোকে বিবিএস এখন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারে। তারা সরকারের অনুমোদন ছাড়াই যে কোনো জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারবে। তবে সেই সক্ষমতা আছে কি না, তা যাচাই করতে হবে।

তিনি বলেন, বিবিএসের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সার্ভে পদ্ধতি জনসম্মুখে উপস্থাপন করতে হবে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনেই জরিপ পরিচালনা জরুরি।

‘টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এখন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যেখানে কোনো তথ্য লুকোচুরি বা কারসাজির সুযোগ নেই। বিবিএসের সব জাতীয় পরিসংখ্যান সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কেউ যদি তথ্যের ঘাটতি বা ভুল খুঁজে পায়, সেটি জানাতে পারবে—এটি বিবিএসের জন্যও ভালো। নতুন বিধিমালায় তথ্য উন্মুক্ত রাখার বাধ্যবাধকতা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।’

উপদেষ্টা বলেন, বিশ্বাসযোগ্য তথ্য উৎপাদনও একটি বিনিয়োগ। বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে প্রবেশের আগে তার পরিসংখ্যান দেখে। তাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে, দেশের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তথ্য তৈরি করতে হবে। শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিয়ে দেশের উন্নয়ন মাপা যাবে না। মানুষের জীবনমান ও সামাজিক সূচকের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। আগে রাজনৈতিক দল ভালো করছে সেটা দেখাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দেখানো হতো। মানুষের জীবনমান উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।

বিবিএসের স্বাধীনতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‌বিধিমালা সংশোধন করার মাধ্যমে বিবিএসকে স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে। অনুমতি ছাড়াই পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে পারবে। তবে খাতের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। এটি সক্ষমতার জন্য প্রয়োজন, যেন তথ্যের স্বচ্ছতা ভালোভাবে নিশ্চিত করা যায়।

সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে টাস্কফোর্সের প্রধান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‌দেশে ৫৩ বছর ধরে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব বেড়েছে। কিন্তু আমাদের তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি হয়েছে। টাস্কফোর্সের মাধ্যমে আমরা পরিসংখ্যানে সংস্কারের সুযোগ পেয়েছি। বিশ্বাসযোগ্য তথ্য নিশ্চিত করতে মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান, প্রাতিষ্ঠানিক গভর্নেন্স ও আর্কিটেক্ট প্রয়োজন।

তিনি বলেন, মানসম্পন্ন নেতৃত্ব ও মানবসম্পদ, মানসম্মত ইকোসিস্টেম, তথ্যের প্রাপ্যতা ও সব স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কোয়ালিটির চাহিদা থাকলে আর্থিক শক্তিশালীকরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবেই পরিসংখ্যানের তথ্য বিশ্বাস ও আস্থার হয়ে ওঠবে।

এমওএস/এমকেআর

Read Entire Article