প্রভুর বাণীতে গাঁথা পুণ্যময় প্রেম

6 hours ago 7
গভীর রাতে পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন জেগে থাকে মহান প্রভু, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এ সময় তিনি নেমে আসেন প্রথম আসমানে এবং শ্রবণ করেন রাতজাগা বান্দার ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া-প্রার্থনা। নবীজি (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহর বিশেষ বান্দারা রাতের শেষাংশকে ইবাদত-বন্দেগির উত্তম সময় হিসেবে বেছে নিতেন; তখন নফল নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির-আজকারে মগ্ন থাকতেন। এ সময় প্রকৃতি নীরব থাকে, পরিবার-পরিজন থাকে ঘুমিয়ে। জাগতিক কোনো কাজকর্মেরও তাড়া থাকে না। ফলে এ সময় আল্লাহর ধ্যান-মগ্ন হওয়া, নফল নামাজ আদায় করা, কোরআন তিলাওয়াত করা এবং জিকির-আজকার করার ক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না; নির্বিঘ্নে আমল করা যায় একমনে, একধ্যানে। এ সময় আল্লাহতায়ালা বান্দার ডাকে অধিক সাড়া দেন। তিনি বান্দাকে অনুপ্রাণিত করতে থাকেন, তাকে ডাকতে বলেন, তার ইবাদত করে তার নৈকট্যলাভের আহ্বান করেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমাদের প্রতিপালক প্রতি রাতের যখন শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে তখন প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, হে বান্দা! আমার কাছে প্রার্থনা করো, আমি তোমার প্রার্থনা কবুল করব। আমার কাছে তোমার কী চাওয়া আছে, চাও, আমি তা দান করব। আমার কাছে তোমার জীবনের গুনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, আমি তোমার গুনাহ মাফ করে দেব।’ (বুখারি: ৬৯৮৬) গভীর রাতে চারদিকে সব যখন নীরব নিস্তব্ধ থাকে, পিনপতন নীরবতায় পৃথিবী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, রাতজাগা নিশিপ্রাণীরাও ঘুমের কোলে আশ্রয় নিয়েছে, কোথাও কারও কোনো সাড়াশব্দ নেই, এমন সুন্দর মধুর সময় আপনি ঘুমের আরাম ছেড়ে উঠে পড়ুন; ঘর কিংবা মসজিদের এক কোণে বসে আল্লাহর কালাম মেলে ধরুন চোখের সামনে। গুনগুনিয়ে পড়তে থাকুন যতক্ষণ মনে চায়। কলুষিত হৃদয় কোরআনের পবিত্র পরশে স্নিগ্ধ করতে যতটা সময় দরকার হয়। এমন নির্জন সময়ে আপনি এক ধ্যানে কোরআন পড়ুন। আপনার মনে হবে আপনি একা। কেউ নেই আপনার চারপাশে। তবে রাতের তিলাওয়াতে একটা আমেজ থাকে। একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার ছাপ থাকে। এ আমেজ যে কারও হৃদয়ে রেখাপাত করবে। মক্কার মুশরিকরাও ছিল না এই দলের বাইরে। প্রকাশ্যে কোরআন শোনার বিরোধিতা করলেও রাতের নির্জনতা ভেদ করে ছুটে যেতেন নবীজির (সা.) ছোট্ট কুটিরের পাশে। রাতের নীরব-নিস্তব্ধতার সুযোগে কোরআনের মৌজে নিজেকে প্লাবিত করতেন গোপনে-সঙ্গোপনে। মক্কার মুশরিকদের মধ্যে অন্যতম ছিল আবু জেহেল, আবু সুফিয়ান ও উতবা। তারা দিনের বেলা ঠিকই অন্যদের রাসুলের কাছে যেতে বাধা দিত কিন্তু রাতের বেলা তারা খুব সন্তর্পণে কোরআন তিলাওয়াত শোনার জন্য রাসুলের ঘরের পাশে গিয়ে লুকিয়ে থাকত। এক রাতে তারা যার যার মতো লুকিয়ে লুকিয়ে কোরআন তিলাওয়াত শুনল। তিলাওয়াত শোনার পর যখন তারা বেরিয়ে এলো, তখন একে অন্যের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কোরআন তিলাওয়াতের প্রতি তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে গেল। ফলে পরস্পরকে তিরস্কার করে শপথ গ্রহণ করল যে, এই ঘরে আর কখনো আসবে না। (সিরাতে ইবনে ইসহাক: ৪/১৫৯; তাফসিরে ইবনে কাসির: ৩/৪৫)। কিন্তু তাদের এ শপথ মুখেই সীমাবদ্ধ থাকল। কোরআনের আকর্ষণের কাছে তাদের শপথ নিতান্তই ঠুনকো প্রমাণিত হলো। তাই পরের রাতেও তিনজনই রাসুলের নিজ মুখে আল্লাহর বাণী শোনার জন্য বাইরে বেরিয়ে এলো। তিন দিন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। কোরআনের প্রতি তাদের আকর্ষণ সৃষ্টি হলেও ঈর্ষাপরায়ণতা ও গোঁড়ামির কারণেই তারা সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল। শুধু মানুষ নয়, কোরআন তিলাওয়াত শুনতে অগণিত ফেরেশতা আসমান থেকে নেমে এসেছে। এমনি এক ঘটনা আছে ইসলামের ইতিহাসে। মদিনায় আল্লাহর রাসুলের সাহাবি উসাইদ ইবনে হুদাইর (রা.) এক রাতের নির্জনতায় সুরা বাকারা তিলাওয়াতে মগ্ন ছিলেন। অদূরেই বাঁধা ছিল তার ঘোড়া। হঠাৎই ঘোড়াটা অস্থির আচরণ শুরু করল! তিলাওয়াতের সময় ঘোড়াটি লাফাতে থাকে। তিলাওয়াত বন্ধ করলে ঘোড়াটিও থেমে যায়। আবার তিলাওয়াত শুরু করলে ঘোড়াটি লাফাতে শুরু করে। তার ছেলে ইয়াহইয়া কাছেই শুয়ে ছিল। তিনি ভীত হয়ে পড়লেন এ কথা চিন্তা করে যে, এমনটি চলতে থাকলে ছেলেটি ঘোড়ার পায়ে পিষে মারা যেতে পারে। তৃতীয়বারের মাথায় তিনি বাইরে এসে দেখেন, আকাশ থেকে ভূপৃষ্ট পর্যন্ত একটি প্রলম্বিত উজ্জ্বল জ্যোতির আভা। তার তিলাওয়াত শেষ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতেই আলোটি অদৃশ্য হয়ে যায়। সকালে নবীকে (সা.) বিস্তারিত খুলে বললেন। নবীজি (সা.) বললেন, উসাইদ! তুমি কি জানো, ওটা কী ছিল? জবাবে সাহাবি না-সূচক উত্তর দিলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, তারা ছিল ফেরেশতা। তোমার তিলাওয়াত শুনে কাছে এসেছিল। তুমি যদি তিলাওয়াত করতে থাকতে, তারাও সকাল পর্যন্ত থেকে যেত, অদৃশ্য হতে পারত না। লোকেরা তাদের দিনের আলোতে দেখতে পেত। (বুখারি: ২/৭৫০; উসদুল গাবা: ১/৯৩; হায়াতুস সাহাবা: ৩/৫৪৩)। সুবহানাল্লাহ! কত বড় নেয়ামত আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। যার তিলাওয়াত করলেও লাভ, শুনলেও লাভ। কাউকে শোনালেও লাভ। কাউকে শুনতে বললেও লাভ। এত দামি ও মহামহিম গ্রন্থ আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। যার প্রতিটি অক্ষর তিলাওয়াতের বিনিময় আল্লাহ ১০টি করে নেকি দান করার ঘোষণা দিয়েছেন। মানবজাতির প্রেসক্রিপশন হিসেবে আল্লাহ কোরআন নাজিল করেছেন। পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ; যা ঘটেছে, যা ঘটছে ও যা ঘটবে—সবকিছু আল্লাহ কোরআনে উল্লেখ করেছেন। সব সমস্যার সুন্দর সমাধানের গাইড হিসেবে আল্লাহ কোরআন নাজিল করেছেন। আপনি হতাশাগ্রস্থ, চিন্তিত, অসুস্থ, পেরেশান, বিষণ্ন কিংবা অবসাদে আছেন? কোরআনের কাছে আসুন। কোরআনের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করুন। কোরআনের বাতলে দেওয়া পদ্ধতি হৃদয়ে ধারণ করুন। আপনি মুক্তি পাবেন। যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে কোরআন নিয়ে বসুন। একাগ্রতায় তিলাওয়াত করুন। তিলাওয়াত শেষে রব্বে কাবার দরবারে দুটি হাত প্রসারিত করে বিগলিত কণ্ঠে আপনার প্রয়োজন তুলে ধরুন। বিশ্বাস রাখুন; আল্লাহ আপনার সব সমস্যার সুন্দর সমাধান করে দেবেন। কোরআনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে আল্লাহতায়ালা নানাভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। তারপরও যদি আমরা কোরআনের প্রেমে উদ্বেলিত না হই তাহলে আমরাই সবচেয়ে বড় হতভাগ্য। সারা দিন কত সময়ই তো এদিক-ওদিক কাটিয়ে দিই। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো-হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, কতশত উপন্যাস-ম্যাগাজিন ও পাঠ্যবই পড়ি। অথচ, মাসকে মাস না পড়ার কারণে তাকের ওপর পবিত্র কোরআন পড়ে থাকে ধুলোমলিন অবস্থায়! খুব ভোরে সন্তানকে পাঠিয়েছেন কোচিংয়ে, তারপর স্কুল, কলেজ কিংবা ভার্সিটিতে। রাতে আবার বসিয়েছেন পাঠ্যবইয়ে। সারা বছর একবারও ছেলের হাতে মানবসভ্যতার প্রেসক্রিপশন আল্লাহর কালাম তুলে দিতে পারেননি, আপনিই বলুন আপনার মতো হতভাগ্য পিতা আর কে আছে! আপনি কীভাবে এ সন্তানের কাছে ভালো ব্যবহার আসা করেন! আপনিই বলুন, কীভাবে আমাদের জীবনে শান্তি আসবে? বারাকাহ আসবে? হৃদয়ে প্রশান্তি পাব! কোরআনের আলোয় একটু আলোকিত করুন নিজেকে। সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে রাতে হলেও পড়ুন মহাগ্রন্থ আল কোরআন। নিজে পড়তে না পারলে আশপাশের কারও থেকে হলেও তিলাওয়াত শুনুন। দেখবেন, রাজ্যের সব প্রশান্তি আপনার কাছে নেমে এসেছে। সারা দিনের ব্যস্ততার রেশ কাটিয়ে আপনি এক স্বর্গীয় সুখে ভাসছেন। রাতের নির্জনতা ভেদ করে যারা আল্লাহর কালাম পাঠে উদ্বুদ্ধ হয়, তাদের উদ্দেশে আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা ওইসব ব্যক্তি, যারা গভীর রাত পর্যন্ত আল্লাহর আয়াতগুলো পাঠ করে এবং সেজদা করে, তারা আল্লাহ ও আখিরাত বিশ্বাস করে এবং সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে এবং সৎ কাজগুলোতে তৎপর থাকে আর তারাই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১৩-১১৪)। আল্লাহ আমাদের কোরআনের আলোর উদ্ভাসিত হওয়ার তওফিক দান করুন। লেখক: ইমাম ও খতিব
Read Entire Article