প্রকৃতি সাজানো এ বরুণ ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;/সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;/সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ/সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, সেখানে বরুণ’।
পলাশ শিমুলের সৌন্দর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার প্রকৃতিতে পসরা সাজিয়ে ফুটেছে চোখজুড়ানো বরুণ ফুল। গাছভর্তি বরুণের সাদা, হালকা হলুদ ও বেগুনি রঙের দৃষ্টিনন্দন ফুল অনেক দূর থেকে চোখে পড়ছে। এতে প্রকৃতি যেন নৈসর্গিক সাজে সেজে উঠেছে। আসা-যাওয়ার পথে এ ফুলের মুগ্ধতায় মুগ্ধ হচ্ছেন ফুলপ্রেমীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বসন্তে অন্যান্য ফুলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থোকায় থোকায় ফুটেছে বরুণ ফুল। কোনো কোনো বাড়ির পাশে, পুকুর ও খালের পাড়ে হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে বরুণ গাছ। অযত্নে বড় হওয়া এসব বরুণ গাছ ফুলে ফুলে সজ্জিত হয়ে উঠেছে। এতে যেন গ্রামীণ সড়কের ও পরিবেশের মধ্যে সৌন্দর্যের এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। অনন্য সুন্দর এ ফুল মুগ্ধ করছে সব বয়সী মানুষকে। কেউ কেউ নিজেদের মোবাইল ফোনে বন্দি করছেন বরুণ ফুলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য।
জানা গেছে, বরুণ একটি বহুবর্ষজীবী ঔষধি গাছ। এটি সাধারণত ১০-২০ মিটার উঁচু হয়। এর ফল গোলাকার বা ডিম্বাকার, শক্ত শাঁসালো। বীজ ও শিকড় থেকে চারা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্রেটভা নুরভালা। সাধারণত বরুণকে গ্রীষ্ম ঋতুর ফুল ধরা হয়। মূলত বসন্তের মাঝামাঝি সময় থেকে বরুণের পুষ্পোচ্ছ্বাস নজর কাড়ে। বৈশাখ পর্যন্ত গাছে গাছে ফুলের সমারোহ থাকে। বরুণ ফুলের রং সাদা, হালকা হলুদ ও বেগুনি। মাসখানেকের বেশি সময় ধরে এ ফুল প্রকৃতিতে রাজত্ব করে। এই গাছে ফুলের পর্ব শেষে কদবেলের মতো ছোট ছোট ফল ধরে। এই ফল পেস্ট করে ভর্তা, ভাজি বা রান্না করেও খাওয়া যায়। স্থানীয়দের কাছে বরুণগাছ বউন্না গাছ নামেই পরিচিত। তবে অঞ্চলভেদে এটি বন্না, বইন্না, শ্বেতপুষ্প, কুমারক, সাধুবৃক্ষ, শ্বেতদ্রুম, মহাকপিথা ও মারুতাপহ নামেও পরিচিত।
বরুণ মূলত একটি ঔষধি গাছ। এ গাছের রয়েছে বিস্ময়কর ঔষধি গুণ। বরুণ গাছের ছাল, পাতা, ফুল ও ফলের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই মানবদেহের নানা রোগে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। চর্মরোগ, গ্যাস্ট্রিক, ক্ষুধামন্দা, বায়ু, কফ, পিত্ত রোগসহ নানা রোগে এর ব্যবহার রয়েছে। এটি মানবদেহের রসবাতে, পায়ের গোড়ালি ও তলায় ব্যথা নিরাময়ে ভেষজ ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিডনি বা পিত্ত থলির পাথর আছে এমন রোগে এ গাছের ছাল ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুখের মেছতায় এর ছাল ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটির ফল মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করে।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, একসময় গ্রামগঞ্জের প্রায় জায়গায় বরুণ গাছ দেখা যেত। এ গাছে ফুল ও ফল আসলে অনায়াসেই মানুষের চোখে পড়তো। তবে এই গাছটি দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করা যায় না বলে এই গাছ নতুন করে রোপণের প্রতি নেই আগ্রহ। যার ফলে উপজেলার গ্রামীণ পরিবেশ থেকে ভেষজ এই গাছটির সংখ্যা দিন দিনই কমে আসছে। এতে ভেষজ এই ওষুধের উপকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকেই।
একাদশ শ্রেণির কলেজের শিক্ষার্থী আতকিয়া তাইয়্যেবা ত্বোয়া বলেন, সারাবছর বরুণ গাছ মানুষের অলক্ষ্যে থাকলেও এ সময়টায় সুন্দর ফুলের কারণে গ্রামের পথে চলতে কোথাও কোথাও চোখে পড়ে বরুণ গাছ। এ ফুলের আকর্ষণীয় সৌন্দর্য সত্যি উপভোগ করার মতো।
প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ প্রকৃতি থেকে অনেক গাছগাছালি হারিয়ে যাচ্ছে। বরুণও তেমনই একটি গাছ যে গাছ। একসময় যে পরিমাণে এ গাছ গ্রামীণ পরিবেশে দেখা যেত এখন আর ততটা দেখা যায় না। বরুণের গাছভরা দৃষ্টিনন্দন ফুল যেকোনো বয়সী মানুষকেই আকৃষ্ট করে। এ গাছের বিভিন্ন অংশ আমাদের মা-চাচিরা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করতো।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইউনানি চিকিৎসক ডা. সোহেল রানা বরুণ সম্পর্কে বলেন, ভেষজ গাছ হিসেবে বরুণ একটি পরিচিত নাম। প্রাচীনকাল থেকেই এ গাছের ছাল, পাতা, ফুল ও ফলসহ বিভিন্ন অংশ মানবদেহের নানা রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এ গাছটিও ঔষধি অন্যান্য গাছের মতো প্রকৃতি থেকে কমে যাচ্ছে। এসব ঔষধি গাছ হারানোর ফলে প্রকৃতিও তার ভারসাম্য হারাতে বসেছে। ঔষধি গাছসহ প্রকৃতির সব ধরনের গাছ টিকিয়ে রাখতে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসা উচিত।