এখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা খুব খারাপ তা বলা যাবে না। যতটুকু আছে ততটুকু দিয়েই আমাদের প্রাধান্য দিয়ে গ্যাস আমদানি করতে হবে। কারণ গ্যাস আমাদের মূল জ্বালানি। প্রতিটি শিল্প কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রয়োজনীয় পরিমাণে গ্যাস দিতে হবে।
জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন মাহফুজ কবির। একান্ত সাক্ষাৎকারে আলাপ করেছেন চলমান অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মো. সামিউর রহমান সাজ্জাদ। আজ থাকছে শেষ পর্ব।
- আরও পড়ুন
- বাংলাদেশের জন্য কোরিয়ায় বাণিজ্যের বড় বাজার তৈরি হবে|
- ছোট ও মাঝারি আকারের ফ্ল্যাট খুঁজছেন ক্রেতারা
- প্রত্যাবাসিত ডলার নগদায়নের হার বৃদ্ধি চায় চিংড়ি রপ্তানিকারকরা
- এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে সহযোগিতা চাইলেন বিজিএমইএর প্রশাসক
জাগো নিউজ: পাচার করা অর্থ পুনরুদ্ধার না করে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে দুর্বল ব্যাংকগুলো তারল্য সহায়তা দেওয়াকে কীভাবে দেখছেন?
মাহফুজ কবীর: আমি মনে করি এই তারল্য সহায়তা আরও তিন মাস আগে দেওয়া হলে, যখন দুর্বল ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছিল, ফলাফল অনেক ভালো হতো। কিন্তু আমার ধারণা, যারা অর্থপাচার করে ব্যাংকগুলো খালি করেছে, তাদের ওপর একটা চাপ তৈরির জন্য এবং তাদের কিছু সম্পদ বিক্রি করে যাতে অর্থ পাওয়া যায় এমন আশা থেকে এতদিন এই তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়নি। কিন্তু সেটা তো হলো না।
এখন দেখা যাচ্ছে যারা ব্যাংক লুট করেছে, তারাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে হুমকি দিচ্ছে যে যদি তাদের সম্পদ বিক্রি করা হয় তাহলে তারা মামলা করবে। কারণ, একটি শিল্প গোষ্ঠী, যারা ব্যাংক লুট করেছে, বলছে যে তারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়। ফলে যে অর্থ তারা বিদেশে নিয়ে গেছে সেটাকে তারা পাচার না বলে বিনিয়োগের অর্থ ফেরত নেওয়া বলতে চাচ্ছেন। তাদের ভাষ্যমতে, তাদের অর্থ ফিরিয়ে নেওয়ার আইনি অধিকার রয়েছে। এটা একটা বড় জটিলতা। এই মামলা লড়ার জন্য তারা আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের প্যানেল নিয়োগ দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে যা যা করেছে সব আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করেছে, বলপ্রয়োগ করেনি। এটি ঋণ খেলাপিরা বুঝে গেছে এবং সুযোগ নিয়ে একটা শিল্প গোষ্ঠী এই মামলার হুমকি দিয়েছে। ফলে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকার অনেকটা উভয় সংকটে পড়েছে।
আমি মনে করি রাষ্ট্র সবচেয়ে শক্তিশালী। সরকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধান করতে চায়। এ অবস্থায় বড় খেলাপিদের অর্থ উদ্ধার ও পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে জটিলতা আরও বাড়বে। এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারণ তারা পার পেয়ে গেলে আরও দশ জন দাঁড়িয়ে যাবে এবং অন্যায় করলেও তারা বলবে ‘আমরা অর্থপাচার করিনি’। এভাবে হয় না। তাদের শাস্তির মুখোমুখি করা সরকারের দায়িত্ব।
‘আরও কিছুদিন এই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে হবে। এতে ব্যাংকগুলো একটু দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। এরই মধ্যে কিছু দুর্বল ব্যাংক দাঁড়ানো শুরু করেছে।’
আসলে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারের দিক থেকে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টার কমতি নেই। অর্থপাচার এবং ঋণ নিয়ে বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক খালি করে ফেলার কারণেই মূল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। যদি তাদের সম্পদ বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া যেত, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে এত বেশি অর্থ ছাপাতে হতো না।
কিন্তু দুর্বল ব্যাংককে ঘুরে দাঁড়াতে টাকা তো দিতে হবে। কারণ, ব্যাংক যেভাবে দুর্বল হয়ে গেছে, তাদের তারল্য সহায়তা দেওয়া ছাড়া পথ নেই। এটা তো এমন নয় যে টাকা একেবারে দিয়ে দেওয়া হবে। বন্ড ছেড়ে অন্য দিক থেকে টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে অর্থের প্রবাহ যাতে বাজারে বেশি না হয় সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই আমি মনে করি না টাকা ছাপালে বড় কোনো সমস্যা আছে।
- আরও পড়ুন
- ১২৩ টাকার বেশি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে পারবে না ব্যাংক
- জানুয়ারিতে ঢাকায় আসছে যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিদল
- আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় আরও এক মাস বাড়লো
- বছরে চার লাখ টন ডিএপি সার দেবে সৌদি আরব
তবে, আগে যেমন বলেছি, তিন মাস আগে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া গেলে ফলাফল ভালো হতো। কারণ, দিন দিন ওই ব্যাংকগুলো আরও দুর্বল হয়ে গেছে এবং অন্যান্য ব্যাংক থেকে তারা ঋণ করেছে। ফলে যাদের থেকে ঋণ নিয়েছে তারা আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণ দিতে পারেনি। ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
আমি মনে করি, দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। আরও কিছুদিন এই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে হবে। এতে ব্যাংকগুলো একটু দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। এরই মধ্যে কিছু দুর্বল ব্যাংক দাঁড়ানো শুরু করেছে। তবে তাদের সময় দিতে হবে। ফলে যদি অর্থ কিছু ছাপানোও হয় সেটা অর্থনীতির জন্য ভালো, আর্থিক খাতের জন্য ভালো। এটা বাজারে অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে না।
এত উচ্চ সুদের হার একটা হঠকারী নীতি। বিশেষ করে বিনিয়োগকারীরা যে এত উচ্চ সুদ দিয়ে দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে না। ফলে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান হবে না এবং নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না।
জাগো নিউজ: একদিকে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কতটা কমবে?
মাহফুজ কবীর: নীতি সুদের হার আমার মনে হয় না আর বাড়ানো উচিত। বরং ধীরে ধীরে কমানো উচিত। যদিও নীতি সুদের হারের সাথে ট্রেজারি বিল, ট্রেজারি বন্ডের রেট অফ রিটার্ন, সুদের হার কতটুকু হবে তা সম্পর্কিত। একটা কথা মনে রাখতে হবে, নীতি সুদ হার বাড়ানো হয়েছে ঠিকই কিন্তু বাজারে যে ঋণের সুদের হার আগে থেকেই বাড়ানো ছিল সেটা কিন্তু বাড়েনি। শুধু ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু সুদের হার অত্যন্ত উঁচু।
সাড়ে ১৫ শতাংশ সুদের হারে শিল্প-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন বিনিয়োগের আগ্রহ খুবই কম। তারা পারতপক্ষে নতুন বিনিয়োগ করতে চাইছে না। বিদেশি বিনিয়োগও কিন্তু খুব আশাব্যঞ্জক নয়। এত উচ্চ সুদের হারে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ভালো মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করছে এটা এখন কারও কাছেই খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
মানুষ মনে করছে যে, এত উচ্চ সুদের হার একটা হঠকারী নীতি। বিশেষ করে বিনিয়োগকারীরা এত উচ্চ সুদ দিয়ে দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে না। ফলে অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থান হবে না এবং নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না।
সুতরাং, এখন নীতি সুদহার ধীরে ধীরে কমাতে হবে এবং বাজারে যে ঋণের সুদের হার আছে এটাও কমাতে হবে। তাহলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে এবং দেশের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চার হবে।
‘ভারত থেকে আমরা যে সব পণ্য নিয়ে আসি এরকম সস্তায় ও কম সময়ে আর কোনো জায়গা থেকে পণ্য পাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে চিকিৎসাসেবা ভারত থেকে সস্তায় কোথাও পাওয়া যাবে না।’
জাগো নিউজ: আমদানি-রপ্তানিতে ভারতের সঙ্গে চলমান কূটনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিতে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে করেন?
মাহফুজ কবীর: এই মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিতে বড় সমস্যা নেই। কূটনৈতিক পর্যায়ে যেগুলো হচ্ছে তা কূটনৈতিকভাবেই সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। গত ৯ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশে এসেছেন এবং তিনি এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন। এটিকে ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন’ বলে। ভারতের দিক থেকে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার এবং বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনা সম্পর্কে বাংলাদেশের দিক থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। ভারতের দিক থেকেও কথাবার্তা বলা হয়েছে।
আমি মনে করি, যে কোনো সমস্যার কূটনীতিক নিরসনই ভালো। এটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হওয়া উচিত। আরও কয়েকটি কনসালটেশন লাগবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সিভিল সোসাইটি, গবেষকরা কথা বলবেন। সাধারণ মানুষের চাওয়া যাতে সরকারের সঙ্গে সরকারের বা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হয়, কোনো দলের সঙ্গে যাতে না হয়।
এই পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুটো। একটা হলো অপতথ্যের অপপ্রচার, অন্যটি ভারতের দিক থেকে অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ভিসা না দেওয়া। গত বছর ভারত বাংলাদেশিদের ১৮ লাখ ভিসা দিয়েছিল, যার বেশিরভাগই ছিল পর্যটক ভিসা। এখানে চিকিৎসা আছে, সাধারণ পর্যটক আছে। এছাড়া কবে ভিসা দেওয়া শুরু হবে তা নিয়েও কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। আমরা কূটনৈতিক যত আলাপই করি খুব একটা লাভ হবে না। ব্যবসায়িক ভিসা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি চালু থাকলে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যদি সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ভারত থেকে আমরা যে সব পণ্য নিয়ে আসি এরকম সস্তায় ও কম সময়ে আর কোনো জায়গা থেকে পণ্য পাওয়া যাবে না।
- আরও পড়ুন
- পদ্মা ব্যাংককে একীভূত করছে না এক্সিম ব্যাংক
- খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, টাকা ছাপানোয় আইএমএফের উদ্বেগ
- টিসিবির পণ্য নিতে মধ্যবিত্তরাও লাইনে
- নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর দাবি
একই সঙ্গে চিকিৎসাসেবা ভারত থেকে সস্তায় কোথাও পাওয়া যাবে না। থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুরে গিয়ে সবার পক্ষে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব নয়। তবে এটাও সত্য যে, সম্মানটা সবচাইতে বড়। সম্মান ও ন্যায্যতার জায়গা ঠিক রেখে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তি পরিবর্তন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুই দেশই স্বাধীন এবং কেউ কারও ওপর হস্তক্ষেপ করা মানুষ পছন্দ করে না।
মাঝে ভারতের একজন রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেন যে, ভারতের পেঁয়াজ, আলু বাংলাদেশে আসা বন্ধ করে দেবেন। বন্ধ কিন্তু হয়নি। তিনি কিন্তু কর্তৃপক্ষ নন। মনে হয় তার উদ্দেশ্যই ছিল উত্তেজনা তৈরি করা এবং বাড়ানো। সীমান্তে স্থলবন্দরে যেটা হয়েছে সেটা অত্যন্ত সাময়িক। এলসি অনুযায়ী তো পণ্য আসবে এগুলোতে কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি।
একদিকে ভারত নেই, অন্যদিকে মিয়ানমার অস্থিতিশীল। এর মধ্যে কে বাণিজ্য করবে? সুতরাং, বিসিআইএমইসি এই মুহূর্তে একটা অসম্ভব প্রকল্প।
জাগো নিউজ: আপনি জানেন নিশ্চয়ই যে নেপালে চায়নার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের ১০টির বেশি চুক্তিতে নেপাল সায় দিয়েছে। বাংলাদেশের এক্ষেত্রে সম্ভাবনা কী?
মাহফুজ কবীর: বাংলাদেশে চীনের বিআরআই প্রকল্পের সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই প্রকল্পের মূল বিষয়টা হচ্ছে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর (বিসিআইএমইসি)। এক্ষেত্রে শুরুতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু পরে দেখা গেলো যে ভারত এতে আগ্রহী নয়। মূল রুট ছিল কুনমিং থেকে কলকাতা।
এখন মিয়ানমারে যে চরম অস্থিতিশীল ও যুদ্ধ পরিস্থিতি, সেখানে এই করিডোর একেবারেই কাজ করবে না। সেখানে যদি অবকাঠামো তৈরি করা হয় তা দিয়ে ঠিক মতো পণ্য আদান-প্রদান করা যাবে না। অর্থাৎ, বাণিজ্য এদিক দিয়ে চলবে না। একদিকে ভারত নেই, অন্যদিকে মিয়ানমার অস্থিতিশীল। এর মধ্যে কে বাণিজ্য করবে? সুতরাং, বিসিআইএমইসি এই মুহূর্তে একটা অসম্ভব প্রকল্প।
নেপাল যেটি করেছে, আমি মনে করি তাদের চুক্তি স্বাক্ষর করা পর্যন্তই থাকতে হবে। এর চাইতে বেশি তারা তেমন কিছু করতে পারবে না। কারণ, করিডোর তৈরি করতে গেলে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশ যদি দেয়ও, ভারত কিন্তু তার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে নাও দিতে পারে।
সুতরাং, চুক্তি হলেই যে বিআরআই প্রকল্প সফল হয়ে গেলো বিষয়টা এরকম নয়। নেপাল যদি কিছু করতে চায় যদি অন্য কোনো রুট দিয়ে তারা চীন থেকে নিয়ে আসতে চায় সেটা অত্যন্ত দুর্গম পার্বত্য এলাকা দিয়ে আসতে হবে। ওই এলাকা দিয়ে কোনো অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এক্ষেত্রে খুব একটা লাভ হবে না।
এছাড়া, চীনা প্রকল্প এখন খুবই ব্যয়বহুল। যেমনটা আমরা শ্রীলঙ্কায় দেখলাম যে হাম্বানটোটা থেকে শুরু করে যা কিছু করা হয়েছে তার জন্য পুরো দেশটা দেউলিয়া হওয়ার পথে চলে গিয়েছিল। কোনোমতে তারা এই যাত্রায় বেঁচে গেছে। সেই পথেই নেপাল হাঁটবে কি না এটাও একটা চিন্তার বিষয়।
নেপালে ব্যবহারযোগ্য জমি আছে মোট ভূখণ্ডের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। সেখানে মানুষের বাড়ি-ঘর, কৃষিকাজের জমি রয়েছে। তারা যদি কোনো অবকাঠামো প্রকল্প করতে যায় সেটার জন্য যদি চীনের সঙ্গে সংযোগ করে ভারতের ওপর দিয়ে যেতে হয়, ভারত সেক্ষেত্রে অনুমতি নাও দিতে পারে। এরকম অনেক জটিলতা রয়েছে।
- আরও পড়ুন
- রিজার্ভ ছাড়ালো ২০ বিলিয়ন ডলার
- সিগারেটে কার্যকর করারোপ না করায় রাজস্ব হারিয়েছে সরকার
- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ: পরিকল্পনা উপদেষ্টা
সুতরাং, চুক্তি স্বাক্ষর করলেই সব বাস্তবায়ন হয়ে যাবে এমনটা ঠিক নয়। বাংলাদেশ এই চুক্তিতে যদি ভারতের কথা বাদও দেয় তারপরও মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে সংযোগ পরিকল্পনা বা প্রকল্প সেটাও আসলে এই মুহূর্তে বাস্তবসম্মত নয়। মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে হবে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হতে হবে। এর পর বিবেচনা করা যেতে পারে।
এছাড়া আরেকটা বড় সমস্যা আছে। একদিকে ভারত এ প্রকল্পে একেবারেই আগ্রহী নয়, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট ভবিষ্যতেই একটা বাণিজ্য যুদ্ধ আসছে বলে শোনা যাচ্ছে। তাই চীন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের বিনিয়োগ স্থানান্তর করছে।
তাই বিআরআই প্রকল্পে বেশি মনোযোগ না দিয়ে আমি মনে করি যে বিনিয়োগ সুবিধাগুলো আসছে সেগুলো গ্রহণ করাটাই বাংলাদেশের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নতুন নতুন চীনা বিনিয়োগ যদি আসে, কোম্পানিগুলো যদি আসে, সেটাই বরং বাংলাদেশের জন্য ভালো।
‘এখন পরিস্থিতি যেটা হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর খুব বেশি আস্থা রাখতে পারছেন না বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। আগেও হয়তো খুব বেশি রাখতে পারতেন না, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে বিভিন্ন অপতথ্য প্রচার এজন্য দায়ী। আবার একইসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সমস্যা রয়েছে।’
জাগো নিউজ: ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনের কারণেই কি বাংলাদেশে কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক বিনিয়োগ হচ্ছে না? আপনার মতামত কী?
মাহফুজ কবির: কোনো নীতি যদি সমস্যা তৈরি করে সেটা তো অবশ্যই পরিবর্তন করা উচিত। পুরোনো ধ্যানধারণা নিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) তো হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ যে উপাত্ত তা এই মুহূর্তে দেড় বিলিয়ন ডলার নিট এফডিআই নেই। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত আমাদের যে পরিস্থিতি তাতে কিন্তু এফডিআই’র অবস্থা খুবই করুণ। আমাদের নীতি পরিবর্তন করেও তো লাভ হচ্ছে না। আগের নীতিও তো ভালো ছিল না।
এখন পরিস্থিতি যেটা হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর খুব বেশি আস্থা রাখতে পারছেন না বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। আগেও হয়তো খুব বেশি রাখতে পারতেন না, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে বিভিন্ন অপতথ্য প্রচার এজন্য দায়ী। আবার একইসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সমস্যা রয়েছে। বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নানান রকমের ঝামেলা পোহাতে হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে সনদ নিতে হয়। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা, ইউটিলিটি ভালো নয়। একই সঙ্গে গ্যাসের দাম বেশি, ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না, জ্বালানি সংকট। এ সমস্যাগুলো সবাই বিবেচনা করেন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। আবার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কিন্তু এখনো রয়ে গেছে।
সুতরাং ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন করি বা না করি আমরা কিন্তু আসলে কিছুই পাচ্ছি না। এত কম বিদেশি বিনিয়োগ দিয়ে কিন্তু আসলে চলবে না। ভিয়েতনামে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ। তাদের শত শত বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। তাদের রপ্তানি ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে বাংলাদেশ ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বের হওয়া দরকার। সুতরাং, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে যদি আমাদের আরও বেশি নীতি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে তাই করা উচিত। যে নীতি কাজে লাগে, বিনিয়োগ নিয়ে আসে সেই নীতি নেওয়াটাই সবচাইতে ভালো।
‘ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্যে জ্বালানি নীতির পরিবর্তন দরকার।’
জাগো নিউজ: বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রাপ্যতা নিয়ে যে সমস্যা যা অনেকদিন ধরে ব্যবসায়ীদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এর সমাধান কী?
মাহফুজ কবির: এটা একটা বড় সমস্যা। ব্রয়লার চালানোর জন্য যে ডিজেল ব্যবহার করা হয়, গত বছর ও ২০২২ সালের শেষ দিকে আমাদের করতে হয়েছে। ২০২৩ একটা সংকটের বছর ছিল। ওই সময় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তখন আমাদের যে রপ্তানি আয় সেখানে খুব বেশি মূল্য সংযোজন হয়নি। অন্যদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য জ্বালানি নীতির পরিবর্তন দরকার।
আমাদের এই মুহূর্তে বেশি করে গ্যাস আমদানি করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস রয়েছে। যদিও সিরিয়ায় যে পরিবর্তনটা হলো এর পরে আমি মনে করি যে মধ্যপ্রাচ্যে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরবে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকলে তখন আমরা বেশি করে গ্যাস আমদানি করব এবং দ্রুত এই পরিকল্পনাগুলো গ্রহণ করতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। এটা করে অবশ্যই আমাদের গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে হবে। কারণ, গ্যাসের সরবরাহ না বাড়ালে গ্যাসের চাপ থাকবে না। তখন খুবই ব্যয়বহুল পদ্ধতি ডিজেল দিয়ে ব্রয়লার চালাতে হবে। এর আগে যখন এই সমস্যা হয়েছিল তখন গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো ঠিকই কিন্তু তবু আমরা গ্যাস সরবরাহ দিতে পারলাম না।
- আরও পড়ুন
- ফের অস্থির ডলার বাজার
- বিশ্বব্যাংক থেকে ১০৮০০ কোটি টাকা ঋণ পেলো বাংলাদেশ
- তিন সপ্তাহে এলো ২ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স
এখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থা খুব খারাপ তা বলা যাবে না। যতটুকু আছে ততটুকু দিয়েই আমাদের প্রাধান্য দিয়ে গ্যাস আমদানি করতে হবে। কারণ গ্যাস আমাদের মূল জ্বালানি। এর সরবরাহ নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতিটি শিল্প কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিমাণে গ্যাস দিতে হবে। তখন আমাদের জ্বালানির জন্য ব্যয়বহুল যে পদ্ধতি ডিজেল ব্যবহার করা লাগবে না। ব্যবসায়ীরা তখন স্বস্তির সঙ্গে উৎপাদন করতে পারবেন এবং রপ্তানি করতে পারবেন।
এসআরএস/এমএমএআর/জিকেএস