আড়াই বছর ধরে ফুসফুসের রোগে ভুগছেন রাবেয়া ইয়াসমীন। থাকেন মধ্যবাড্ডায়। প্রতিদিন গড়ে ১৭০ টাকার ওষুধ খেতে হয় তার। অভাবের সংসারে ওষুধ কিনতে হিমশিম। তার মধ্যেই হঠাৎ একসঙ্গে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত স্বামী ও ছয় বছরের মেয়ে। পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসার পর ওষুধ নয়, তাদের খাবারের খরচ মেটাতেই হিমশিম গৃহবধূ রাবেয়ার।
তার ভাষ্য, ‘ডাক্তার কইছে এ রোগের আপাতত বেশি ওষুধ নাই। পেঁপে, লেবু, মাল্টা, ডাব, স্যালাইনসহ ফল-ফ্রুট বেশি খাওয়াইতে কইছে। তাইলেই নাকি এমনিই ভালো হইয়া যাইবো। তয় ফলের যে দাম, তার চেয়ে ডাক্তার ওষুধ লিইখ্যা দিলেই ভালা হইতো।’
শুধু রাবেয়া নন, ডেঙ্গু আক্রান্ত অধিকাংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের রোগীর খাবার খরচ মেটাতে হিমশিম অবস্থা। ডেঙ্গু থেকে পরিপূর্ণভাবে সেরে উঠতে বাড়তি খাবারের পেছনে বড় অংকের অর্থ গুনতে হচ্ছে তাদের। মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীরাও কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।
আমরা ফল বলতে আপেল-আঙুর, কমলা-মাল্টাই বুঝি। পেঁপে খেতে হবে সেটার দাম বাজারে যতই হোক, ডাব খেতে হবে সেটারও দাম যতই হোক! আসলে বিষয়টি মোটেও এমন নয়। কোনো চিকিৎসকই এ দামি খাবার কিনে খেতেই হবে এটা রোগীকে বলছেন না।- ইউনাইটেড হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আফসানা বেগম
যদিও চিকিৎসকরা বলছেন, অনেকে না বুঝে ‘ফল’ বলতে বিদেশি ও দামি ফল; যেমন—আপেল, আঙুর, মাল্টা, ড্রাগনের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। আর তরল ও পানীয়জাতীয় খাবার বলতে ডাব, জুস ধরে নিয়ে অতিরিক্ত খরচ করছেন। বিদেশি দামি ফলের পরিবর্তে রোগীদের দেশীয় ফল ও ডাবের পানির বদলে স্যালাইন খাওয়ালেও উপকার পাবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সেরে উঠতে খরচ কেমন?
ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুমে জ্বর, শরীর ব্যথার লক্ষণ দেখা দিলেই পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফলে একজন ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত কি না, তার জন্য প্রথমেই তাকে টেস্ট করাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত একটি ফি রয়েছে। সেটি সরকারি হাসপাতালে কিছুটা কম এবং বেসরকারি হাসপাতালে কিছুটা বেশি।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে জানা যায়, কেউ ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে গেলে তাকে প্রথমে দুটি টেস্ট করা হয়। ‘এনএস-১’ ও ‘সিবিসি’। এনএস-১ টেস্টে মূলত ডেঙ্গু পজিটিভ কি না, তা জানা যায়। এটি করাতে সরকারি হাসপাতালে ১০০ টাকা দিতে হয়। তবে বেসরকারি হাসপাতালে এটি করাতে ৩০০ টাকা ফি নির্ধারণ করেছে সরকার।
সবাই ডাব খাওয়া শুরু করলে ডাবের দাম বাড়বে। ঢাকায় ডাব পাবেনই বা কোথায় এত? এজন্য শুধু ডাব নয়, কম দামে ওরস্যালাইন কিনে খেলেও প্রায় একই রকম উপকার মিলবে। বাজার থেকে কেনা প্রক্রিয়াজাত করা জুস খাবেন কেন? লেবুর রসের জুস খান। সহজলভ্য ও একই পুষ্টিগুণ আছে, এমন খাবার খেলে এ খরচটা কমে আসবে।-ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
অন্যদিকে সিবিসি হলো—একজন মানুষের শরীরে রক্তের সামগ্রিক একটি পরীক্ষা। বেসরকারি হাসপাতালে সিবিসি টেস্টে খরচ ৪০০ টাকা। সরকারি হাসপাতালে কোথাও ১৫০ টাকা, কোথাও ১০০ টাকায়ও করানো হয়।
রাজধানীর মধ্যবাড্ডার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়কর্মী। গত অক্টোবরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন তিনি। টানা দুদিন জ্বর থাকায় পার্শ্ববর্তী ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেন্ট সেন্টারে যান। প্রথমে ৭০০ টাকা দিয়ে এনএস-১ ও সিবিসি টেস্ট করান। তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। রক্তে প্ল্যাটিলেট সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার।
- আরও পড়ুন
- ২৮৫ টাকা রেখে বিক্রেতা বললেন দুই টাকা কম রাখলাম মামা
- দেশি ফলের দাম বেড়েছে
- ডেঙ্গুর চিকিৎসা খরচ জোগাতে নাভিশ্বাস নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে
- বেশি খরচে ডেঙ্গুর ‘ভালো’ চিকিৎসা, দিনে ৫ হাজার টাকা
সিরাজুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্ল্যাটিলেট ভালো দেখে বাসায় ছিলাম। দুদিন পরই শরীর দুর্বল ও অসহনীয় হয়ে ওঠে। তখন একজন চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম। ৮শ টাকা ভিজিট নেন তিনি। কিন্তু কোনো ওষুধ লেখেননি। শুধু খাবারের লিস্ট ধরিয়ে দেন। সঙ্গে একদিন পরপর টেস্ট করাতে বলেন।’
চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি একদিন পরপর মোট পাঁচবার টেস্ট করান। পঞ্চমবারের মাথায় তার ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। এরপর আর টেস্ট করাননি। সিরাজুল বলেন, ‘যেহেতু ডাক্তার ফল ও তরল খাবার বেশি খেতে বলেছিলেন, সেজন্য কমলালেবু, মাল্টা, বিভিন্ন ধরনের জুস বেশি খেয়েছি। তাছাড়া দিনে দুইটা করে ডাব খেতাম। হিসাব করলে দেখা যাবে, দুইটা ডাবে ২৩০ টাকা আর ফল ও জুস মিলিয়ে দিনে খরচ হতো এক হাজারের বেশি। আর ওষুধ খেতাম মাত্র দুইটা নাপা বড়ি। তাতে ৫ টাকা খরচ।’
সিরাজুলের দেওয়া তথ্যমতে, প্রায় ১৫ দিনের অসুস্থতায় টেস্ট ও ওষুধের পেছনে তার খরচ হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকার বেশি। আর বাড়তি খাবারের পেছনে ব্যয় হয়েছে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। বিষয়টি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা যেমন খুব কষ্টের অসহনীয় যন্ত্রণার, আবার খাবারের দিক বিবেচনা করলে মনে হয় এ যেন বিলাসিতার রোগ।’
ইউনাইটেড হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আফসানা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ফল বলতে আপেল-আঙুর, কমলা-মাল্টাই বুঝি। পেঁপে খেতে হবে—সেটার দাম বাজারে যতই হোক, ডাব খেতে হবে- সেটারও দাম যতই হোক! আসলে বিষয়টি মোটেও এমন নয়। কোনো চিকিৎসকই এ দামি খাবার কিনে খেতেই হবে—এটা রোগীকে বলছেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, তাহলে আপনার সাধ্যমতো বা সামর্থ্যমতো খাবার খান। প্রয়োজনে সেগুলোও ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন। ডাবের পানি খাওয়ার সক্ষমতা নেই, তাহলে কী করবো? এটা চিকিৎসককে জিজ্ঞাস করুন। নিশ্চয়ই তিনি বলবেন না যে আপনাকে এটা খেতেই হবে। আমি তো মনে করি, বাজারে যে সাধারণ লেবু পাওয়া যায়, সেটার শরবত বানিয়ে খান। খাবার স্যালাইনে জোর দেওয়া যেতে পারে।’
সংকটাপন্ন রোগীর ‘চিকিৎসা-খবার’ দুই খরচই বেশি
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে অনেকে মারা যাচ্ছেন। প্রতিদিন গণমাধ্যমে সেই খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়। ফলে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়। ভয়-শঙ্কায় অনেকের হৃদরোগের সমস্যা দেখা দেয়। তাছাড়া আগে থেকে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা ডেঙ্গু পজিটিভ হওয়ার দ্বিতীয় থেকে চতুর্থদিনের মধ্যে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
অনেকে তলপেটে ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, রক্তক্ষরণ, শরীর আড়ষ্ট হয়ে আসার মতো সমস্যায় ভোগেন। কোনো ডেঙ্গুরোগী এমন পরিস্থিতিতে পড়লে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি হয়ে পড়ে। বেসরকারি হাসপাতালে এমন রোগীদের জন্য চিকিৎসা খরচ বেড়ে যায় বহুগুণ।
শারীরিকভাবে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাজধানীর বাড্ডায় অবস্থিত বেসরকারি এ এম জেড হাসপাতালে ভর্তি হন সেলিম উদ্দিন। পেশায় তিনি ব্যবসায়ী। চারদিন চিকিৎসা নিয়ে গত ২৯ নভেম্বর হাসপাতাল ছাড়েন। ছাড়পত্র নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হাসপাতালের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে।
সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘২৫ তারিখ (নভেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে ভর্তি হয়েছিলাম। চারদিন ছিলাম। আজ (২৯ নভেম্বর সকাল) বেরিয়ে যাচ্ছি। চারদিনের ভাড়া নিয়েছে, সঙ্গে চিকিৎসা খরচ। সবমিলিয়ে ২৩ হাজার টাকা শুধু হাসপাতালের বিল এসেছে। ওষুধ বা ইনজেকশন এবং স্যালাইন ফার্মেসি থেকে আমাদের কিনতে হয়েছে। খাবারও নিজেদের কেনা। হিসাব করলে তো সবমিলিয়ে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে।’
এ এম জেড হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের সমন্বয়ক আমিনুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হিসাব অনুযায়ী আমাদের এখানে খরচ খুবই কম। রোগীদের সেবা নিশ্চিতে তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক-নার্সরা তৎপর। বলা চলে প্রতি চারজন রোগীর জন্য এখানে আমরা একজন নার্স রেখেছি। কোয়ালিটি অনুযায়ী বেড ভাড়াও খুব কম। দিনে মাত্র দুই হাজার টাকা। ভালো সেবা নিতে হলে একটু খরচ বাড়তি হবেই।’
তবে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে খরচ কিছুটা কম। মগবাজারের বাসিন্দা আশরাফুল আলম। তার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে ভর্তি করেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে সিট ভাড়া নেই। টেস্টের খরচ খুবই সীমিত। বিনামূল্যে রোগী দেখছেন চিকিৎসক।
২৬ নভেম্বর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে কথা হয় আশরাফুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে সবই প্রায় ফ্রি। শুধু স্যালাইন কেনার জন্য টাকা দিতে হচ্ছে। আর খাবার কিনতে হচ্ছে। সেটাই বড় খরচ।’
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ (নার্স) তনুশ্রী হালদার বলেন, ‘এখানে প্রচুর রোগী। আমরা স্টাফরা সাধ্যমতো সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। এখানে তো কোনো খরচ নেই। স্যালাইনও অনেক সময় বিনামূল্যে দেওয়া হয়। তবে স্যালাইন সংকট দেখা দিলে রোগীদের জরুরিভিত্তিতে কিনতে বলা হয়।’
বেশি দামের চেয়ে রোগ নিরাময়ে বেশি কার্যকর খাবার খেলে খরচ কমবে বলে মনে করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবাই ডাব খাওয়া শুরু করলে ডাবের দাম বাড়বে। ঢাকায় ডাব পাবেনই বা কোথায় এত? এজন্য শুধু ডাব নয়, কম দামে ওরস্যালাইন কিনে খেলেও প্রায় একই রকম উপকার মিলবে। বাজার থেকে কেনা প্রক্রিয়াজাত করা জুস খাবেন কেন? লেবুর রসের জুস খান। সহজলভ্য ও একই পুষ্টিগুণ আছে, এমন খাবার খেলে এ খরচটা কমে আসবে।’
তবে ডেঙ্গু ‘সহজভাবে নেওয়া যাবে না’ জানিয়ে ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘সতর্ক ও সচেতন থাকাটা খুব জরুরি। তারপরও যদি আক্রান্ত হয়েই যান, তাহলে দ্রুত টেস্ট করাতে হবে। শারীরিক অবস্থার অবনতি বা বিশেষ কোনো লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’
এএএইচ/এএসএ/জিকেএস