বিনির জীবনে নোমির আগমন এক রহস্যময় অধ্যায়। অদ্ভুত এক যোগাযোগ ছিল তাদের মধ্যে—যেন কোনো এক অলিখিত বন্ধনে বাঁধা ছিল তারা।
নোমি ছিল কর্মঠ, বাস্তববাদী এক যুবক। যে নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য লড়াই করছিল। আর বিনি? সে ছিল একদম উল্টো। আবেগপ্রবণ, কল্পনাপ্রবণ, ভালোবাসার জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক মেয়ে। প্রথমদিকে তাদের সম্পর্কটা ছিল একদমই নিখুঁত। প্রতিদিন সকালে নোমির প্রথম কথাটা থাকতো বিনির জন্য—
‘সুপ্রভাত, লক্ষ্মীটি!’
সকালের নরম রোদ্দুরের মতোই শান্তি দিতো শব্দগুলো। বিনি ঘুম থেকে উঠে মুচকি হাসতো।
‘তুমি কেমন আছো?’
‘তোমাকে দেখে ভালো হয়ে গেলাম।’ বলতো নোমি।
এভাবেই চলছিল তাদের দিনগুলো। বিনির কাছে নোমি ছিল রাজা। যার জন্য সে প্রতিদিন ভালোবাসার মুকুট গেঁথে রাখতো। কিন্তু সময় বদলায়। দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছিল। নোমি ব্যস্ত হয়ে পড়ছিল কাজের চাপে। অফিস, ভবিষ্যৎ, পরিবার—সবকিছু মিলিয়ে তার সময়ের অভাব হচ্ছিল।
‘তুমি কি আমার সাথে ঠিক আগের মতোই আছো?’ একদিন জিজ্ঞেস করল বিনি।
নোমি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি আছি... কিন্তু অনেক কিছু বদলাচ্ছে, বিনি।’
বিনি বুঝতে পারছিল, বদল এসেছে। নোমির কণ্ঠে এক ধরনের ক্লান্তি। এক ধরনের এড়িয়ে যাওয়ার ভাব।
‘তোমাকে তো সময় দিচ্ছি না ঠিকঠাক, তাই না?’
বিনি কিছু বলল না। সে শুধু অনুভব করছিল, তার নোমি ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে।
একদিন নোমি বলল, ‘আমার অনেক কিছু গুছিয়ে নিতে হবে, বিনি। আমার মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই দরকার। বাবা-মাকে একটা ভালো জীবন দিতে হবে। আমি ঋণের বোঝা নিয়ে তোমার সাথে সুখী হতে পারবো না।’
‘আমার তো কেবল তোমাকে চাই, নোমি।’ বলে ওঠে বিনি।
‘এটা এত সহজ না।’
‘কেন সহজ না? আমরা একসাথে লড়তে পারি।’
নোমি নীরব হয়ে গেল। তারপর বলল, ‘আমি এখন সম্পর্কের কোনো পূর্ণতা দিতে পারবো না, বিনি।’
সেদিন রাতে বিনি অনেকক্ষণ কাঁদল। সে জানতো, ভালোবাসা মানেই সব সময় একসাথে থাকা নয়। কিন্তু সে কি এত সহজেই হার মানতে পারবে?
সময় কেটে যাচ্ছিল। নোমি মাঝে মাঝে আসতো, আবার হারিয়ে যেত। বিনির দিন কেটে যেত অপেক্ষার মধ্যে।
‘তুমি কি ফিরে আসবে?’
‘আমি জানি না, বিনি।’ নোমির কণ্ঠ ছিল নিস্তেজ।
বিনি তার হৃদয়ে অনুভব করল এক অপূর্ণতা। এক ধরনের শূন্যতা যা ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছে।
একদিন বিনি আর নোমির মধ্যে শেষবারের মতো কথা হয়।
‘আমি ক্লান্ত, বিনি। আল্লাহর ওয়াস্তে আর যোগাযোগ করো না। আমি সাইকো হয়ে যাচ্ছি।’ বলল নোমি।
বিনি চুপ করে রইল।
‘তুমি বলো, আমি না থাকলে কি খুশি থাকবে?’
নোমি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি জানি না কিন্তু আমি চাই তুমি ভালো থাকো।’
‘তুমি কি সত্যিই চাও আমি ভালো থাকি?’
নোমি উত্তর দিলো না। বিনি জানতো, সে হয়তো আর কখনো নোমিকে ফিরে পাবে না। তবুও সে অপেক্ষা করল।
‘আমি জানি, হয়তো একদিন সব বদলে যাবে। হয়তো তুমি ফিরে আসবে অথবা হয়তো এটাই ছিল আমাদের গল্পের শেষ পৃষ্ঠা। কিন্তু আমার হৃদয়ে তুমি চিরকাল থাকবে, নোমি।’
বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল। প্রতিটি ফোঁটায় যেন বিনির হৃদয়ের প্রতিধ্বনি বাজছিল। অপেক্ষা... শুধু অপেক্ষা। বিনি জানতো, জীবন শুধু ভালোবাসার গল্প নয় বরং এক দীর্ঘ প্রতীক্ষা। কিছু ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। কিছু ভালোবাসা অপেক্ষার রেখায় থেকে যায়—অসমাপ্ত, অথচ গভীর।
এসইউ/এমএস