ঢাকার ব্যস্ত সড়কে হাঁটলে চারপাশে শুধু তাড়া আর ভিড়। গাড়ির হর্ন, মানুষের ভিড় আর অবিরাম কোলাহল যেন এই নগরীর প্রতিদিনের সঙ্গী। তবে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে যে ফুটওভার ব্রিজটি রয়েছে, সেখানে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে এক ভিন্ন দৃশ্য।
এই ফুটওভার ব্রিজ কেবল পথচারীদের নিরাপদ চলাচলের মাধ্যম নয়, এটি যেন হয়ে উঠেছে এক ‘ছোট্ট শপিংমল’, যেখানে আছে স্বল্প মূল্যে জীবনের নানা প্রয়োজনীয় জিনিস। আছে বিক্রেতাদের হাসিমুখ আর ক্রেতাদের দৈনন্দিন গল্প।
ব্যস্ত ব্রিজে দোকানের সারি
ব্রিজে উঠলেই একেক পাশে সাজানো পসরা দেখে মনে হবে যেন মেলায় ঢুকে পড়েছি। ছোট্ট টেবিল, কাপড়ের চাদর, কিংবা মাটির ওপরে ছড়িয়ে রাখা নানা পণ্য। নেই বড় দোকানের ঝলমলে সাইনবোর্ড, নেই এয়ারকন্ডিশনের ঠাণ্ডা বাতাস। তবু এখানে ক্রেতাদের ভিড়।
কেউ বসেছেন ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে। দাম শুরু মাত্র ২০০ টাকা থেকে, আর ভালো মানের বড় ব্যাগ মিলছে দেড় হাজার টাকার মধ্যে। অনেকেই অফিস শেষে বা ভ্রমণে যাওয়ার আগ মুহূর্তে এখান থেকেই ব্যাগ কিনে নিচ্ছেন। এক দোকানি মুচকি হেসে বললেন, ‘ভাই, বড় দোকানে গেলে এই ব্যাগের দাম তিন হাজার বলবে, আমরা দিচ্ছি অর্ধেকেরও কমে। তাই মানুষ খুশি মনে কিনে নিয়ে যায়।’
কথা হয় ব্যাগ নিয়ে আসা রাব্বির সঙ্গে। তার বাড়ি মানিকগঞ্জে। একটু সচ্ছল জীবনের আশায় গ্রামে পরিবার-স্বজন রেখে এসেছেন এই ব্যস্ত নগরীতে। প্রতিদিন বিকেলের পর এই ফুটওভার ব্রিজে ব্যাগের পসরা সাজিয়ে বসেন তিনি। এখানে বেচাকেনা চলে রাত প্রায় ১২টা পর্যন্ত। ব্যাগ বিক্রির টাকায় চলে তার জীবন। শুধুই রাব্বিই নন, এখানে পণ্য নিয়ে বসা সব দোকানির রয়েছে আলাদা আলাদা গল্প। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তারা তাদের জীবন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
ধর্মীয় পণ্য থেকে কসমেটিকস
কিছুটা এগোলেই মিলবে আতর আর টুপির দোকান। ছোট ছোট কাঁচের বোতলে রাখা আতরের গন্ধ বাতাসে মিশে যায়। নামাজের আগে পরে আতরের বোতল বা নতুন টুপি কিনে নেন অনেকেই।
- আরও পড়ুন
- ঈদ শেষ, এখন সস্তায় স্টাইলের সময়
- মধ্য ও নিম্নবিত্তদের ভরসা ফুটপাতের দোকান
- মৌচাক মার্কেটে একদিন
আরেকটু দূরেই দেখা যাবে রঙিন কসমেটিকসের সারি। লিপস্টিক, নেইলপলিশ, আইশ্যাডো, ফেসপাউডার-সবই সাজানো থাকে ছোট বাক্সে। দামও হাতের নাগালে, ৫০ টাকায় যেমন লিপস্টিক আছে, আবার ২০০-৩০০ টাকায় ভালো মানের সেটও পাওয়া যায়। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েরা থেমে যান, হাতে হাতে মিলিয়ে নেন রঙ, আর দরদাম করে কিনে নেন।
ইলেকট্রনিক্সের ছোট্ট বিস্ময়
ব্রিজের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হলো ছোট ছোট চার্জার ফ্যান। গরমে হাঁটতে হাঁটতে এমন ফ্যান হাতে নিলে যেন মুহূর্তেই স্বস্তি আসে। দামও মাত্র ১৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। একজন ক্রেতা বলছিলেন, ‘বাসে চড়লে খুব গরম লাগে, তাই আমি একটা ফ্যান কিনলাম। ছোট, কিন্তু দারুণ কাজের।’
সঙ্গে আছে মোবাইল চার্জার, হেডফোন, ইয়ারফোন, ডেটা কেবল-সবকিছুই স্বল্প মূল্যে।
ছেলেদের জন্য বিশেষ আয়োজন
যারা ফ্যাশন সচেতন, তাদের জন্য রয়েছে মানিব্যাগ, সানগ্লাস আর ঘড়ির দোকান। ১০০ টাকার সাধারণ মানিব্যাগ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকার স্টাইলিশ ডিজাইন-সবই মিলছে এখানে। একইভাবে ২০০–৩০০ টাকার সানগ্লাস, ৩০০ টাকার ঘড়ি তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
শিশুদের আনন্দমেলা
শিশুরা এখানে আসতে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত হয় খেলনার দোকান দেখে। সফট টয়, ছোট গাড়ি, পুতুল, বাদ্যযন্ত্র-সব মিলিয়ে রঙিন এক দুনিয়া। বাবা-মায়েরা সন্তানকে খুশি করতে ৫০-১০০ টাকার খেলনা কিনে দেন আর বাচ্চাদের হাসি যেন পুরো ব্রিজকে আলোকিত করে।
ফুলের সুবাসে ভরা সন্ধ্যা
দিনের শেষে সবচেয়ে মন ছুঁয়ে যায় ফুলের দোকানগুলো। টাটকা গোলাপ, বেলি আর গাজরা বিক্রি করেন অনেকেই। অফিসফেরত কেউ প্রিয়জনের জন্য একটি গোলাপ হাতে নেন, আবার কেউ বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে গাজরা কিনে নেন। এক ফুল বিক্রেতা বললেন, ‘ফুল মানেই খুশি। মানুষ যখন হাসিমুখে ফুল কিনে নেয়, তখন মনে হয় সারা দিনের কষ্ট সার্থক।’
অস্থায়ী এই বাজারের জনপ্রিয়তার রহস্য
ঢাকার বড় শপিংমলে গেলে চোখে পড়ে আড়ম্বর, দামি ব্র্যান্ড আর উচ্চমূল্যের ট্যাগ। সেখানে এই ব্রিজের দোকানগুলো একেবারেই সহজ-সরল। স্বল্প আয়ের মানুষ যেমন স্বস্তিতে কিনতে পারেন, তেমনি মাঝেমধ্যে প্রয়োজন মেটাতে মধ্যবিত্তরাও থেমে যান। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সময় বাঁচানো। ব্রিজ পার হতে হতে চোখে পড়ে দরকারি জিনিস, আর মুহূর্তেই লেনদেন সেরে ফেলা যায়।
ছোট ব্যবসায়ীদের জীবনসংগ্রাম
এই বাজার চালান মূলত নিম্ন আয়ের মানুষরা। কারও সংসারে ছোট ছোট সন্তান, কারও বৃদ্ধ মা-বাবা। কেউ পড়াশোনার খরচ জোগাতে বসেছেন, আবার কেউ বেকারত্ব কাটিয়ে জীবিকা গড়েছেন এই ছোট্ট দোকান দিয়ে।
একজন বিক্রেতা বললেন, ‘বড় দোকান করার সামর্থ্য নেই। এখানে দিনে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে। কখনো ভালো বিক্রি হয়, কখনো একেবারেই না। কিন্তু এই বাজারই আমাদের বাঁচার ভরসা।’
নগরজীবনের সঙ্গে একাত্মতা
ঢাকার মতো শহরে যেখানে জীবনযাত্রার খরচ প্রতিদিন বাড়ছে, সেখানে এই ফুটওভার ব্রিজ যেন স্বস্তির জায়গা। ক্রেতারা পকেটের হিসেব মিলিয়ে কেনাকাটা করতে পারেন, আর বিক্রেতারা ছোট হলেও একটি স্বপ্ন আঁকড়ে বেঁচে থাকেন। এ ব্রিজের বাজার শুধু কেনাকাটার জায়গা নয়, এটি আসলে নগরজীবনের এক প্রতিচ্ছবি-যেখানে মানুষ নিজের সাধ্য অনুযায়ী সুখ খুঁজে নেয়।
যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে ফুটওভার ব্রিজ এখন কেবল রাস্তা পার হওয়ার মাধ্যম নয়-এ যেন সাধারণ মানুষের ছোট্ট শপিংমল। এখানে আছে সাধ্যের ভেতর স্বপ্ন, আছে বিক্রেতাদের সংগ্রামের গল্প, আর আছে ক্রেতাদের ক্ষণিকের আনন্দ। ব্যস্ত এই নগরীর আড়ম্বরপূর্ণ মল আর ব্র্যান্ডের ভিড়ে এই ব্রিজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়-সবচেয়ে দামি জিনিস নয়, বরং সহজলভ্য আর হৃদয়ের কাছে পৌঁছানো জিনিসই মানুষের প্রকৃত সঙ্গী।
জেএস/জিকেএস