ফুটপাতজুড়ে দেশি-বিদেশি বইয়ের ভাণ্ডার

3 weeks ago 15

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ পার হলেই চোখে পড়ে, বইপ্রেমীদের পরিচিত এক আড্ডাস্থল – নীলক্ষেত। ফুটপাতজুড়ে সাজানো সারি সারি বইয়ের দোকান যেন অন্যরকম এক জগৎ। এখানে হাঁটলেই চোখে পড়ে বইয়ের পাহাড়, আর দামও এমন, যে কেউ কিনতে পারবেন সহজেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই থেকে শুরু করে ক্লাসিক সাহিত্য, গল্প-উপন্যাস কিংবা অনুবাদ সবই মেলে এখানে। অনেক সময় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহৃত রেফারেন্স বই, গবেষণা পত্রিকা বা 'আউট অফ প্রিন্ট' হয়ে যাওয়া বইও খুঁজে পাওয়া যায়। ফলে যারা স্বল্প খরচে পড়াশোনা চালাতে চান, তাদের কাছে নীলক্ষেত এক অমূল্য রত্নভাণ্ডার।

একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, জনপ্রিয় মার্কিন লেখিকা কলিন হুভার'র বইয়ে ভরপুর ফুটপাতের দোকানগুলোতে। 'ইট এনডস উইথ আস', 'ইট স্টার্টস উইথ আস' কিংবা 'রিমাইন্ডারস অফ হিম' – সবই পাওয়া যায় মাত্র ১০০-২০০ টাকার মধ্যে। অথচ বইয়ের বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে এগুলো কিনতে গেলে খরচ করতে হয় শত শত টাকা। শুধু কলিন হুভারই নন, জোজো ময়েজ, জন গ্রীন, পাউলো কোয়েলহো কিংবা ক্লাসিক সাহিত্যিক শেক্সপিয়র, জন মিল্টনদের বইও সহজলভ্য।

ফুটপাতজুড়ে দেশি-বিদেশি বইয়ের ভাণ্ডার

বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এমনই – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সবাই জায়গা পেয়েছেন ফুটপাতের বুকশেলফে। হিমু ও মিসির আলির সিরিজ, ইন্দুবালা ভাতের হোটেল, আরণ্যক, পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুলনাচের ইতিকথা, কিংবা কাকাবাবু সমগ্র সব মিলে এখানে গড়ে উঠেছে এক বৈচিত্রময় ভাণ্ডার।

এখানকার প্রধান ক্রেতারা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের কাছে নীলক্ষেত যেন এক সোনার খনি। কারণ নতুন বইয়ের দাম তাদের সাধ্যের বাইরে হলেও, নীলক্ষেতের ফুটপাতে একই বই মেলে অনেক কম দামে। অনেক শিক্ষার্থী নিজেদের পুরানো বই বিক্রি করে দিয়ে অন্য বই কেনেন, ফলে একই সঙ্গে বই কেনা-বেচার বাজার হিসেবেও জায়গাটি জনপ্রিয়।

তিন দশক ধরে নীলক্ষেতে বই বিক্রি করছেন সোহরাব হোসেন। তার মতে, বই নির্বাচন নির্ভর করে পাঠকের চাহিদার উপর। আগে ইংরেজি বইয়ের এতো চাহিদা ছিল না। বিগত ৮-৯ বছর ধরে ইংরেজি উপন্যাস আর মোটিভেশনাল বইয়ের চাহিদা আকাশছোঁয়া। ‘ক্রেতারা এসে বারবার যেসব বইয়ের নাম জিজ্ঞেস করে, আমরাও সেই বই সংগ্রহ করি’, বলেন তিনি।

নীলক্ষেতের ফুটপাতে বই বিক্রি করেন মোহাম্মদ মাহিন। তিনি ২২ বছর ধরে বইয়ের ব্যবসায় নিয়োজিত। তার দোকানে বিভিন্ন ধরনের নতুন ও পুরোনো বই থাকে। তিনি বলেন, নতুন বইয়ের তুলনায় পাঠকরা পুরোনো বইকে বেশি প্রাধান্য দেন। তাই তিনি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বই সাজিয়ে রাখেন।

‘আমার এখানে উপন্যাসের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে।’ তিনি আরও জানান, দৈনিক প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়। পুরোনো বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় মে, জুন ও জুলাই মাসে, কারণ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ও অনার্সে ভর্তি শুরু হয়, ফলে এই সময়ে বিক্রির পরিমাণ বাড়ে।

ফুটপাতজুড়ে দেশি-বিদেশি বইয়ের ভাণ্ডার

এখানের পুরানো বা ব্যবহৃত বইগুলো হাতেগোনা কিছু টাকাতেই পাওয়া যায়। কোনো কোনো বই তো মাত্র ৫০-৬০ টাকায় কেনা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইও এখানে পাওয়া যায় অর্ধেক দামে। ফলে শিক্ষার্থীরা অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি নানা ধরনের বই পড়ার সুযোগ পান।

মূল্য যে কতটা সাশ্রয়ী, তা জানা যায় শিক্ষার্থীদের মুখেই। সামিয়া ইসলাম নামের এক ছাত্রী বলেন, “স্টুডেন্ট হিসেবে আমার বাজেট সীমিত। নীলক্ষেত আমার কাছে 'গোল্ড কয়েন' এর মতো। এখান থেকে বই কিনে পড়া শেষে চাইলে আবার বিক্রিও করে দিতে পারি।”

বইয়ের মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে পুরনো বই দোকানগুলোর সামনে এসেছেন ইডেন কলেজের তিন শিক্ষার্থী। সুমাইয়া নূর, জেবা আহমেদ ও স্মৃতি আক্তার – তিনজনই ইংরেজি সাহিত্য এবং নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের বই পড়তে পছন্দ করেন।

সুমাইয়া নূর বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্যের কীর্তিমান লেখকদের লেখা আমার ভালো লাগে। রবিন শর্মার 'দ্যা মঙ্ক হু সোল্ড হিজ ফেরারি' এবং অ্যালিস মুনরোর ছোট গল্প‌ও পড়েছি। আমি প্রায়ই এখানে আসি, কলেজের কাছাকাছি হওয়ায় সুবিধা হয়। কম খরচে পুরানো বই কিনতে পারি এবং আজও একটি বই নিয়েছি।’

মার্কেটের শেষপ্রান্তে সাজানো রয়েছে টাইপিং ও বাঁধাইয়ের দোকান। বই কেনার পাশাপাশি এখানে পুরোনো বই মেরামত বা বাঁধাই করানো যায়, যা নীলক্ষেতকে এই দিক দিয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান বানিয়েছে। এছাড়া বিদেশি ভাষার নতুন বই, যা অনলাইনে নামিয়ে আনা হয়, তা বাঁধাই করার জন্যও নীলক্ষেত বিশেষভাবে পরিচিত। এখানকার দক্ষ কারিগররা কম খরচে ফটোকপি করে শিটগুলোকে একদম মূল বইয়ের মতো করে বাঁধাই করে দেন।

শুধু কেনাবেচা নয়, নীলক্ষেত বইপ্রেমীদের জন্য আড্ডারও জায়গা। বই খুঁজতে খুঁজতে অনেক সময় পাঠকরা নতুন কোন‌ পাঠকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যান। কিংবা অচেনা কাউকে দেখে বইয়ের নাম জানার আগ্রহ জাগে। ফুটপাতে বসা দোকানিদের সঙ্গেও তৈরি হয় একধরনের সম্পর্ক। যারা নিয়মিত আসেন, তাদের পছন্দের বই আগে থেকেই আলাদা করে রাখে দোকানিরা।

আজকের ডিজিটাল যুগে, যখন সবকিছু অনলাইনভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে, তখনও নীলক্ষেতের উন্মুক্ত আড্ডা আর বইয়ের স্পর্শ মানুষকে ফিরিয়ে আনে কাগজের ঘ্রাণের কাছে। কেননা কাগজে পড়ার স্বাদ, স্ক্রিনে মিলে না। তাইতো গরম দুপুর, বৃষ্টিভেজা বিকেল বা শীতের সকালে যেকোনো সময়েই এখানে ভিড় জমে থাকে। হয়তো এ কারণেই নীলক্ষেত কেবল একটি বইপাড়া নয়, বরং বইপ্রেমীদের প্রাণচক্র।

এএমপি/জেআইএম

Read Entire Article