ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি : দিবসেই শুধু কদর বাড়ে নিহতদের পরিবারের

3 hours ago 4

ফুলবাড়ী ট্র্যাজেডি দিবস আজ। ২০০৬ সালের এই দিনে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘিরে রক্তাক্ত হয় এই উপজেলা। গুলিতে নিহত হন তিন যুবক।

নিহত সেই তিন যুবকের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তাদের মা-বাবা-ভাইবোনসহ পরিবারগুলো। প্রথম প্রথম তাদের খোঁজখবর নেওয়া হলেও এখন আর তেমন কেউ খোঁজ রাখেন না। শুধু ২৬ আগস্ট খনিবিরোধী ট্র্যাজেডি দিবসেই নিহতদের পরিবারগুলোর কদর বাড়ে। একই অবস্থার শিকার আহত হয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা গুলিবিদ্ধসহ দুই শতাধিক নারী ও পুরুষের। 

এরই মধ্যে গুলিবিদ্ধ প্রদীপ সরকার পরলোকগমন করেছেন। অন্য গুলিবিদ্ধ বাবলু রায় এখন চিকিৎসার অভাবে দিন কাটাচ্ছেন।  

নিহতদের মধ্যে রাজশাহী নিউ ডিগ্রি কলেজের ছাত্র তরিকুল ইসলাম সম্ভ্রান্ত পরিবারের হলেও অন্য দুজন আমিন ও সালেকিন ছিলেন হতদরিদ্র ও অসহায় দিনমজুর পরিবারের ছেলে। তরিকুল শিক্ষার্থী থাকলেও আমিন ও সালেকিন ছিলেন তাদের পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমিন ও সালেকিনকে হারিয়ে তাদের পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

কেমন আছে আমিনের পরিবার

ফুলবাড়ী পৌর এলাকার বারোকোনা গ্রামের দিনমজুর আব্দুল হামিদের ছেলে আমিনুল ইসলাম। চার ভাইবোনের মধ্যে আমিন বড়। ছোটবোন হানিফা বেগম, ছোটভাই আল আমিন ও সর্বকনিষ্ঠ বোন হুমাইরা আফরিন। আমিন পেশায় ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। বাবার পাশাপাশি তিনিও সংসারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ২০০৬ সালে আমিনের বয়স ছিল ১৪ বছর। দেশের মাটি রক্ষার্থে সকলের মতো আমিনও বাড়ি থেকে মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে মিছিলে বেরিয়ে পড়েন। মিছিলে গুলিবর্ষণ শুরু হলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।

আমিন মারা যাওয়ার পর ধার-দেনা করে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে বাবা-মা। আমিনের মা রেহেনা খাতুন বলেন, আজ আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আমাদের এত কষ্টে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হতো না। ছেলের আয়ে অন্তত তিন বেলা পেটে ভাত জুটত। প্রথম প্রথম খোঁজখবর নেওয়া হলেও এখন আর কেউ তেমন খোঁজ রাখে না।

কেমন আছে সালেকিনের পরিবার

নবাবগঞ্জ উপজেলার উত্তর শাহাবাজপুর গ্রামের ঝোড়ারপাড়া গ্রামের হাসান আলী ও শেফালী বেগমের ছেলে সালেকিন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সালেকিন তৃতীয়। সালেকিনের বাবা হাসেন আলী কৃষিশ্রমিক। ২০০৬ সালে সালেকিন সবে প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক জীবন শুরু করেছিল। গ্রামের সবাইকে আন্দোলনে যেতে দেখে সালেকিনও উৎসাহিত হয়ে মিছিলে বেরিয়ে পড়েন ফুলবাড়ীর দিকে। চাচা জোবেদ আলীর সঙ্গে ফুলবাড়ী এলেও পরে দুলাভাইয়ের সঙ্গে আন্দোলনে থাকেন। চারদিকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে সেই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সালেকিন।

সালেকিনের মা শেফালী বেগম বলেন, স্কুল থেকে ফিরেই না খেয়ে মিছিলে ঢুকে ফুলবাড়ীতে চলে যায় সালেকিন। তাকে অসংখ্যবার বললাম সেখানে গন্ডগোল হবে যাস না। কিন্তু তবুও সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। আমি পথ চেয়ে রইলাম। সালেকিন বাড়ি ফিরল ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। সারা বছর আমাদের কেউ খবর নেয় না। শুধু প্রতিবছরের ২৬ আগস্ট এলেই আমাদের খোঁজ নেওয়া হয়। সালেকিন মারা যাওয়ার পর অনেকে সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। বৃদ্ধ অসুস্থ স্বামী হাসান আলী বিছানায় পড়ে যাওয়ায় এখন আমাদের খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।

কেমন আছে তরিকুলের পরিবার

ফুলবাড়ী পৌর এলাকার উত্তর সুজাপুর (চাঁদপাড়া) গ্রামের সাবেক পৌর কাউন্সিলর ও শিক্ষক মরহুম মোকলেছুর রহমানের ছেলে আবু সালেহ তরিকুল ইসলাম। তিন ভাইয়ের মধ্যে তরিকুল ছিলেন বড়। তার ছোটভাই সাদ্দাম হোসেন ও তৌকির আহম্মেদ তপু। তরিকুল রাজশাহীর নিউ গর্ভমেন্ট কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট তরিকুল তার ছোটভাই সাদ্দামকে নিয়ে আন্দোলন দেখতে ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যান। সাদ্দাম জীবিত ফিরলেও তরিকুল ফেরেন লাশ হয়ে।

তরিকুলের পরিবারের লোকজন জানান, সেদিন দুপুরে দুই ছেলে ফুলবাড়ী পৌরশহরে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আন্দোলন দেখতে যায়। বিকেলে পিতা মোকলেছার রহমানের কাছে ফোন আসে বিডিআরের গুলিতে তরিকুল মারা গেছে। পরদিন দিনাজপুর থেকে তার মরদেহ আনা হয়। তার শূন্যতা নিয়েই পরিবারের মা-ভাইবোন বেঁচে আছেন।

খনিবিরোধী আন্দোলনের ফুলবাড়ী শাখা তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম জুয়েল ও সদস্য সচিব জয় প্রকাশ গুপ্ত বলেন, নিহত আমিন ও সালেকিনের পরিবারকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের। তবে প্রথম থেকেই তরিকুলের পরিবার কোনো ধরনের সহযোগিতা নেননি।

Read Entire Article