পুরান ঢাকার ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এর গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় অবৈধভাবে ফের দোকানপাট নির্মাণের পাঁয়তারা করছে একটি চক্র। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পদক্ষেপে এ তৎপরতা আপাতত বন্ধ।
পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান নির্মাণের পক্ষে নয় ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এর ব্যবসায়ীদের একাংশ। তাদের ভাষ্য, পার্কিংয়ে দোকান নির্মাণ করলে এই মার্কেটের স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, তখন মার্কেটে আগত ক্রেতাদের গাড়ি পার্কিং এবং মালামাল ওঠা-নামার কোনো জায়গা থাকবে না। বাধ্য হয়ে যানবাহন সড়ক ও ফুটপাতে পার্কিং করতে হবে। তাই চক্রটি কোনোক্রমেই যাতে পার্কিংয়ে দোকান নির্মাণ করতে না পারে, ডিএসসিসিকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্র জানায়, সোহেল আহম্মেদ, মো. বাকের হোসেন, মো. মাসুদ রানা, এমডি হাবিব, কামরুল আহছান, মো. মহিউদ্দিনসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী পার্কিংয়ে দোকান বরাদ্দে সোচ্চার। তারা বিভিন্ন সময় আদালতে রিটও করেন। ৫ আগস্টের পর এসব ব্যবসায়ী মিলে আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে পার্কিংয়ে দোকান বসানোর চেষ্টা করেন। তবে ডিএসসিসি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রতিহত করেছে। এসব ব্যবসায়ীর দাবি, তারা অতীতে দোকান বরাদ্দ পেয়েছিলেন। অর্থ লগ্নি করে এখন তারা ক্ষতিগ্রস্ত।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এ নকশাবহির্ভূত দোকান নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। ওই চক্রটি যতই চেষ্টা করুক, তাদের কখনো দোকান নির্মাণে অনুমোদন দেওয়া হবে না। এরই মধ্যে ওই মার্কেটে গাড়ি রাখার জন্য পার্কিং ইজারা দেওয়া হয়েছে। শিগগির ইজারাদারকে পার্কিং বরাদ্দের কার্যাদেশ দেওয়া হবে।’
ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২
ডিএসসিসির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের দক্ষিণ পাশেই ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২। জাকের প্লাজা, সিটি প্লাজা, নগর প্লাজা নামে আলাদা তিনটি বিপণিবিতান নিয়ে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২। এ তিনটি বিপণিবিতানের পার্কিংয়ের জায়গায় আগে ৯১১টি ও চারপাশের ফুটপাতে আরও এক হাজারের বেশি অবৈধ দোকান ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ৬শ জন ব্যক্তি ডিএসসিসি থেকে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, হকার পরিচয় দিয়ে অস্থায়ীভাবে দোকান বরাদ্দ নিয়েছিলেন। বর্তমানে পার্কিংয়ে দোকান বসানোর চেষ্টাকারীদের মধ্যে তারাও কেউ কেউ আছেন।
- আরও পড়ুন
দখলমুক্ত হলো ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের ৫ দোকান
ফুলবাড়িয়া মার্কেটে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ, ধানমন্ডিতে বাড়ি সিলগালা
ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কমিটি
ফুলবাড়িয়া মার্কেটে ফের উচ্ছেদ অভিযান, ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ
২০২০ সালে ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেওয়ার পর সব অস্থায়ী বরাদ্দ বাতিল করেন। পরে টানা একমাস অভিযান চালিয়ে এই মার্কেটের পার্কিং ও চারপাশের ফুটপাত থেকে সব দোকান উচ্ছেদ করে ডিএসসিসি। এরপর থেকে চার বছর ধরে পার্কিং ইজারা দিয়ে আসছিল সংস্থাটি। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার কয়েক দিন পর ফের পার্কিংয়ের জায়গায় অবৈধভাবে দোকান তৈরি করেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। খবর পেয়ে ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ এসব দোকান ফের গুঁড়িয়ে দেয়।
মার্কেটের স্থানে দোকান বরাদ্দ দিলে ব্যবসায়ীদের অনেক সমস্যা হবে। এই মার্কেটে সারাদেশ থেকে ক্রেতারা গাড়ি নিয়ে আসেন আবার অনেকে ভাড়া করা গাড়িতে অথবা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মাধ্যমে পণ্য নিয়ে যান। যদি পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান নির্মাণ করা হয়, পুরো মার্কেটের বাণিজ্য কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।- জাকের সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী কামাল হোসেন
ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, গত ২২ অক্টোবর ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এ গাড়ি পার্কিং ইজারার জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ কারাবী। এর কয়েকদিন পরই এই ইজারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করেন সোহেল আহম্মেদ, মো. বাকের হোসেন, মো. মাসুদ রানা। এই রিট আবেদনে তারা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত দোকানি হিসেবে দাবি করেন। তখন আদালত পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান বসানোর অনুমতি দেন।
একইভাবে এমডি হাবিব নামে আরেকজন পার্কিং ইজারার বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করতে উচ্চ আদালতে আলাদা রিট করেন। তারাও আদালত থেকে দোকান বসানোর আদেশ পান। এই আদেশের সূত্র ধরে তারা ডিএসসিসিতে দোকান বসানোর আবেদন করেন। পরে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। গত ২২ নভেম্বর এই পার্কিংয়ে দোকান নির্মাণকাজের আদেশে স্থিতাবস্থা জারি করেন আদালত। এর আগে গত ৫ নভেম্বর মার্কেটের পার্কিং ইজারা চূড়ান্ত করে ডিএসসিসি। এখন ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী দাবি করা এমডি হাবিব বলেন, এই মার্কেটের পার্কিংয়ে ডিএসসিসি তাদের অস্থায়ী দোকান বরাদ্দ দিয়েছিল। বিনিময়ে ডিএসসিসি মাসে মাসে ভাড়া নিয়েছে। তারা ট্রেড লাইসেন্সও দিয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে কোনো নোটিশ ছাড়াই বা বরাদ্দ বাতিল না করেই পার্কিংয়ে থাকা সব দোকান ভেঙে দেন। এতে হাজারো ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন যদি পার্কিংয়ে দোকান বরাদ্দ দিতে না পারে, তা হলে বিকল্প ব্যবস্থাও (পুনর্বাসন) ডিএসসিসিকে করতে হবে।
ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০ সালে ওই ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদের পর থেকে ফের পার্কিংয়ে দোকান বসাতে চেষ্টা করেন তারা। এছাড়া ২০২০ সালে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এর সভাপতি কামরুল আহছান, সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিনসহ ৭২ জন সদস্যকে পার্কিংয়ে দোকান বরাদ্দে রিট করেন। এই রিটের এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। এর বাইরে আরও অনেকে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত দাবি করে ডিএসসিসিতে আলাদা আবেদন করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, জাকের সুপার মার্কেট, সিটি প্লাজা ও নগর প্লাজার নিচতলা ফাঁকা। গত আগস্টে যেসব অবৈধ দোকান ভাঙা হয়েছিল, সেগুলোর ইট-পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ফুটপাতের অনেক হকার পার্কিংয়ের জায়গায় মালামাল স্তূপ করে রেখেছে।
একদল লোক ওই মার্কেটের পার্কিংয়ে দোকান বসাতে উচ্চ আদালতে রিট করেন। আদালত তাদের দোকান বসানোর অনুমতিও দেন। পরে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে স্থিতাবস্থা জারি করেন আদালত। আইন অনুযায়ী পার্কিংয়ে দোকান বসানোর সুযোগ নেই।- ডিএসসিসির আইন কর্মকর্তা মো. তারিন ইসলাম
জাকের সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী কামাল হোসেন বলেন, ‘মার্কেটের স্থানে দোকান বরাদ্দ দিলে ব্যবসায়ীদের অনেক সমস্যা হবে। এই মার্কেটে সারাদেশ থেকে ক্রেতারা আসেন পাইকারি পণ্য কিনতে। তারা অনেকে গাড়ি নিয়ে আসেন আবার অনেকে ভাড়া করা গাড়িতে অথবা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মাধ্যমে পণ্য নিয়ে যান। এখন এই তিন মার্কেটে পার্কিং ব্যবস্থা সচল না থাকার কারণে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মালামাল ওঠানো হয়। এতে দিনের বেশিরভাগ সময় রাস্তায় যানজট লেগে থাকে। এর মধ্যে যদি পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান নির্মাণ করা হয়, পুরো মার্কেটের বাণিজ্য কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
২০১৪ সালে সিটি প্লাজার পার্কিংয়ে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১০০ বর্গফুট আয়তনের একটি দোকান ৫৬ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন মাজেদুল ইসলাম। ২০২০ সালে তার দোকানের মালামালসহ গুঁড়িয়ে দেয় ডিএসসিসি। আলাপকালে মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘হাবিব নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে দোকানটি কিনেছিলাম। তারপর থেকে দোকানে ভালোই বেচাকেনা হচ্ছিল। কিন্তু দোকানটি ভেঙে ফেলার পর পথে বসতে হয়েছে। এখন আবার পার্কিংয়ে দোকান বসানোর জন্য সম্প্রতি আদালতে রিট করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। আদালত দোকান বসানোর অনুমতি দিলেও সিটি করপোরেশন আপত্তি জানিয়েছে।’
জানতে চাইলে ডিএসসিসির আইন কর্মকর্তা মো. তারিন ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘একদল লোক ওই মার্কেটের পার্কিংয়ে দোকান বসাতে উচ্চ আদালতে রিট করেন। আদালত তাদের দোকান বসানোর অনুমতিও দেন। পরে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে স্থিতাবস্থা জারি করেন আদালত। আইন অনুযায়ী পার্কিংয়ে দোকান বসানোর সুযোগ নেই। বিষয়টি আদালতকে অবগত করেছি। কেউ যাতে দোকান বসাতে না পারেন, তা আইনগতভাবেই দেখবো।’
এমএমএ/এএসএ/জেআইএম