ঢালিউডের আকাশে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি অকালেই নিভে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় সালমান শাহর মৃত্যুর ২৯ বছর পরও তার আলো নিভে যায়নি। আদালত যখন অবশেষে তার হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া চালুর নির্দেশ দেয়, তখনো তার নাম উচ্চারণে মানুষের চোখ ভিজে ওঠে, টাইমলাইনে ভেসে আসে তার ছবি, সংলাপ, স্টাইল। সময় থেমে গেছে ২৪ বছর বয়সী এক তরুণের মুখে-যিনি আজও অগণিত মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।

সালমান শাহ শুধু পর্দার নায়ক ছিলেন না, ছিলেন একটি যুগের ‘স্টাইল আইকন’। নব্বই দশকের শুরুর ঢালিউডে যখন ফ্যাশন মানে ছিল প্রচলিত পোশাক আর চেনা ধরন, তখনই তিনি এনে দিয়েছিলেন এক ভিন্ন ঢেউ।

নিউট্রাল শেডের টি-শার্ট, জিন্স, ওভারসাইজড শার্ট কিংবা ফিটেড পোশাক-সব কিছুতেই তিনি ছিলেন স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর। তার ব্যাকব্রাশ করা চুল, কপালে বাঁধা ব্যান্ডানা কিংবা নেপালি টুপি-সবই যেন নতুন প্রজন্মের ফ্যাশনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এক সময় পুরো ঢাকার তরুণেরা হুবহু তার মতো চুল রাখত, তার মতো পোশাক পরত।

আজকের দিনে একজন তারকার ফ্যাশনের পেছনে থাকে বিশাল টিম-স্টাইলিস্ট, মেকআপ আর্টিস্ট, ফ্যাশন ডিরেক্টর। কিন্তু সালমান শাহ ছিলেন পুরোপুরি নিজস্ব স্টাইলে গড়া। তার ফ্যাশনের নকশা আঁকা হতো তার নিজের মনের ক্যানভাসে।

তার সঙ্গে কাজ করা নির্মাতারা জানান, সিনেমার পোশাক নির্বাচনের ব্যাপারে সালমানের রুচির ওপরই নির্ভর করতেন তারা। পরদিন শুটিং থাকলে আগের দিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটত নিউমার্কেটের দোকানে দোকানে। নিজে কাপড় কিনে, টেইলরের পাশে বসে সেলাইয়ের ধরন নির্ধারণ করতেন তিনি। শুধু পোশাক নয়, সঙ্গে মিলিয়ে কিনতেন জুতা, বেল্ট, ঘড়ি, সানগ্লাস। সবকিছুই নিজের হাতে বেছে নিতেন।

বিদেশে শুটিংয়ে গেলে ফিরতেন কয়েকটি বড় লাগেজ ভরা পোশাক নিয়ে। সিনেমার চরিত্র অনুযায়ী জুতা পর্যন্ত আলাদা রাখতেন। ফরমাল দৃশ্যের জন্য লোফার, ক্যাজুয়াল দৃশ্যের জন্য কনভার্স, আবার রোমান্টিক দৃশ্যের জন্য হাই বুট। তার অল্প দিনের ক্যারিয়ারে ব্যবহৃত জুতার সংখ্যা ছিল তিন শতাধিক।

পুরুষেরা সাধারণত বাঁ হাতে ঘড়ি পরেন-এটাই প্রচলিত রীতি। কিন্তু সালমান ছিলেন অন্যরকম; তিনি সব সময় ডান হাতে ঘড়ি পরতেন। তার সংগ্রহে ছিল নানা ব্র্যান্ডের ঘড়ি, যার মধ্যে দেড় লাখ টাকার রাডো ঘড়িটি তিনি পরেছিলেন জীবনের শেষ দিনেও। গলায় পাতলা চেইন, হাতে ব্রেসলেট-এই ছোট ছোট অলংকারও তার ব্যক্তিত্বে আনত ভিন্ন আবেদন। তিনি জানতেন, ফ্যাশন কেবল পোশাক নয় বরং নিজের মধ্যে এক ধরণের সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ।

তার মুখ ছিল ডিম্বাকৃতি ওভাল শেপড। ফলে গোলাকার, এভিয়েটর, ওয়েফ্যারার-সব ধরনের সানগ্লাসেই তাকে দারুণ মানাতো। কখনো সিনেমার দৃশ্যে, কখনো অফস্ক্রিন মুহূর্তে তাকে দেখা যেত সানগ্লাসের আড়ালে মিষ্টি হাসিতে মুগ্ধ করে রাখতে। চশমার পাশাপাশি ব্যবহার করতেন কনটাক্ট লেন্সও, যা সেই সময়ের একজন অভিনেতার জন্য ছিল সাহসী ও আধুনিক পদক্ষেপ।

নব্বই দশকে যারা তরুণ ছিলেন, তাদের কাছে সালমান শাহ ছিলেন এক স্বপ্ন। তার ‘কে তুমি’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘বিক্ষোভ’, ‘আনন্দ অশ্রু’-প্রতিটি সিনেমার পর্দায় তিনি যেন নতুন প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস হয়ে উঠেছিলেন। তখন রাস্তায় বের হলে দেখা যেত, অসংখ্য তরুণ সালমানের মতো পোশাক পরছে, চুল রাখছে, চশমা পরছে। যেন সবাই তার মধ্যেই খুঁজে নিচ্ছে নিজের পরিচয়।

১৯৯৬ সালের সেই কালো দিনে সালমান শাহ চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি হারিয়ে যাননি। তিনি বেঁচে আছেন প্রতিটি ভালোবাসার চিঠিতে, প্রতিটি তরুণের হেয়ারস্টাইলে, প্রতিটি মেয়ের মনের নায়কে। ২৯ বছর পরও তিনি যেমন ছিলেন আকর্ষণীয়, আত্মবিশ্বাসী, রুচিশীল ও অদ্বিতীয়-ঠিক তেমনই আছেন আজও।

সালমান শাহ শুধু এক নাম নয়; তিনি এক অনন্ত অনুভূতি। তার ফ্যাশন কেবল পোশাকের নয়, এক ধরণের আত্মপ্রকাশ-যা সময়কেও হার মানায়। হয়তো সেটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য, চলে গিয়েও তিনি থেকে গেছেন আমাদের মনের ঠিক কেন্দ্রে, এক চিরকালীন ‘স্টাইল আইকন’ হয়ে।
জেএস/

2 hours ago
5









English (US) ·