বই না পেয়ে স্কুল বিমুখ প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা

3 hours ago 4

নতুন বছরের প্রথম মাস প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এখনও একটি বইও হাতে পায়নি প্রাথমিক স্তরের প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। বই না পাওয়ায় ক্লাসে তেমন একটা উপস্থিতিও নেই শিক্ষার্থীদের। এমনকি অনলাইন থেকে প্রিন্ট করে শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে মিলছে না অনলাইন কপি। শহর এলাকায় অভিভাবকরা নিজ খরচে অনলাইন কপি প্রিন্ট করে তাদের সন্তানদের হাতে দিলেও বঞ্চিত হচ্ছেন প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থীরা।

গ্রামীণ এলাকার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে পুরোনো বই দিয়ে দু’একটা ক্লাস করানো হচ্ছে। তাও আবার এক বেঞ্চে একটি বই দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হচ্ছে। পুরোনো বইয়ের সংকট থাকায় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে দুই বেঞ্চের শিক্ষার্থীরা মিলে একটি মাত্র বই দেখার সুযোগ পাচ্ছে।

এদিকে বই না পাওয়ার ‘অজানা শঙ্কায়’ গ্রামীণ এলাকার অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের মাদরাসায় নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। এতে করে বিদ্যালয়ে উপস্থিতি একেবারে কমে যাচ্ছে।

অন্যদিকে শহরের শিক্ষার্থীরা খুব একটা মাদরাসামুখী না হলেও বই না থাকায় স্কুল বিমুখ হচ্ছে তারা। তবে অনেকে পাঠ্যবইয়ের অনলাইন কপি সংগ্রহ করে পড়াশুনা শুরু করেছে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা গুণতে হচ্ছে অভিভাবকদের। এতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্প আয়ের অভিভাবকরা।

সিলেট নগরীর উপশহর এলাকার আশা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শামসুজ্জামান খালেদ বলেন, প্রাথমিক স্তরের প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির অনেক অভিভাবক এনসিটিবির ওয়েবসাইটে থাকা পাঠ্যবইয়ের অনলাইন কপি প্রিন্ট করে নিয়ে যাচ্ছেন। গত এক সপ্তাহে অন্তত ১৫-২০ জন অভিভাবক অনলাইন কপি প্রিন্ট করেছেন। বেশিরভাগ অভিভাবক বিভিন্ন বইয়ের প্রথম দিকের ২০-২৫ পৃষ্ঠা করে প্রিন্ট করছেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেক বইয়ে তাদের খরচ পড়ছে গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।

নগরীর অম্বরখানা এলাকার কম্পিউটার ও স্টেশনারি ব্যবসায়ী আব্দুল খালেক বলেন, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনেক অভিভাবক এসে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বইয়ের প্রথম অধ্যায় প্রিন্ট করেছেন। এখনও প্রতিদিন অনেকে এসে প্রিন্ট করছেন। যাদের আর্থিক সমস্যা রয়েছে তারা সাদাকালো প্রিন্ট করছেন।

এদিকে সিলেটের কানাইঘাট, জকিগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলাসহ কয়েকটি এলাকার প্রাথমিকের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে শুধুমাত্র প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। বাকি প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কোনো বই বিদ্যালয়ে পৌঁছায়নি। সময়মতো পাঠ্যবই সরবরাহ করতে না পারায় এসব ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে। আর যেসব শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যায় তাদেরকে পুরোনো বই দিয়ে পাঠদান করা হয়। ক্লাস শেষে আবার বই অফিসে সংরক্ষণ করে রাখা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব শিক্ষকরা বলেন, পুরোনো বইও না থাকায় এক বেঞ্চের শিক্ষার্থীদের একটি বই দিয়ে পাঠ করানো হয়। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে দুই বেঞ্চের শিক্ষার্থীরা মিলে একটি বই পাঠ করে।

কানাইঘাট উপজেলার চতুল ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির কোনো বই বিদ্যালয়ে পৌঁছায়নি। পুরোনো বইও নেই। কয়েকটি বই থাকায় সেগুলো পাঠদানের সময় ক্লাসে নিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হয়। ক্লাস শেষে আবার নিয়ে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এক বেঞ্চের শিক্ষার্থীদের একটি বই দিয়ে ক্লাস করাতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সময়মতো বই সরবরাহ করতে না পারায় অনেক অভিভাবকের মধ্যে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনেকে তাদের শিক্ষার্থীদের মাদরাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী মাদরাসায় চলে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেসব শিক্ষার্থী বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একদিনও ক্লাসে আসেনি।

একই উপজেলার দিঘীরপাড় ইউনিয়নের প্রাথমিকের এক শিক্ষক বলেন, বই না পাওয়ায় বছরের শুরু থেকেই চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসছে না। মাত্র ৫-৬ জন শিক্ষার্থী ক্লাসে আসে। যারা ক্লাসে আসে তাদেরকে পুরোনো বই দিয়ে পড়ানো হয়।

পাঠ্যবইয়ের অনলাইন কপি সরবরাহ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় অনলাইন কপি প্রিন্ট করে নিয়ে আসার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে প্রিন্ট কপিও দেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা অনলাইন কপি বোঝে না, তাদের কাছে বই জরুরি।

তিনি আরও বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে নতুন বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা বই পেয়ে আসছিল। এ বছর সেই ধারাবাহিকতা না থাকায় অনেকেই ধরে নিয়েছেন বই পাবেন না। এজন্য কিছু কিছু শিক্ষার্থী ক্লাসে আসছে না।

জকিগঞ্জ উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, বই না থাকায় চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করা যাচ্ছে না। গড়ে ৪-৫ জন শিক্ষার্থী ক্লাসে আসে। কিছু শিক্ষার্থী মাদরাসায় চলে যাওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মাদরাসাগুলোর ব্যাপক প্রচারণা অন্যতম একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাখাওয়াত এরশেদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব বই বিতরণ করা হয়েছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির তিনটি করে বই উপজেলা পর্যায়ে চলে এসেছে। এগুলো বিতরণ করা শুরু হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছাবে।

তিনি বলেন, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ের অনলাইন কপি প্রিন্ট করে পাঠদান করানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এগুলো কেন মানা হচ্ছে না তা খতিয়ে দেখা হবে।

শিক্ষার্থীদের মাদরাসায় চলে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাদরাসার বইও এখনো দেওয়া হয়নি। তাহলে কেন স্কুল থেকে মাদরাসায় যাবে। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হবে।

এফএ/এএসএম

Read Entire Article