বদলেছে সাতক্ষীরা পাসপোর্ট অফিসের দালালদের কাজের ধরন

4 weeks ago 18

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে অনেক কিছুই। ভোগান্তি কমেছে সরকারি সেবাদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠানে। আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস সাতক্ষীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে থেমে নেই দালালদের কার্যক্রম। পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কাজের ধরন বদলেছে সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দালালরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, আবেদন জমা কাউন্টারে সেবাপ্রার্থীদের সুশৃঙ্খল লাইন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জমা থেকে শুরু করে বায়োমেট্রিকসহ সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে সেবাপ্রার্থীরা অফিস ত্যাগ করছেন। সেবাপ্রার্থীদের সেবা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি যোগদান করা অফিস প্রধান নিজেই ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এসবের মধ্যেই চলছে দালালদের কার্যক্রম। মূলত দূরদূরান্ত থেকে আাসা আবেদনকারীরা অফিসের আশপাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকানে আবেদন ফরম পূরণ করতে গেলে বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে তারা কৌশলে পাসপোর্ট অফিস ও পুলিশের নাম ভাঙিয়ে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন অতিরিক্ত টাকা। এসব কর্মকাণ্ডে বিব্রত হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সেবাগ্রহীতাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দালালদের সখ্যতা থাকার একটা সময় পাসপোর্ট অফিসে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তির যেন শেষ ছিল না। স্বাভাবিক নিয়মে পাসপোর্ট ফরম জমা দিতে গিয়ে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতো সেবাপ্রত্যাশীরা। পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা দিলে নানা ধরনের অসঙ্গতি দেখিয়ে ফাইল বাতিলসহ বিভিন্ন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তাদের। ফলে ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে দালাল সিন্ডিকেটের শরণাপন্ন হতেন তারা। সেখান থেকেই যেন রীতি হয়ে আছে দালাল ছাড়া পাসপোর্ট হয় না। তবে পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হয়েছে পাসপোর্ট অফিসের সেবার মান। 

বুধবার (২৭ নভেম্বর) সকালে সরেজমিনে সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায় উপপরিচালকের রুমের সামনে ঘোরাফেরা করছেন শ্যামনগর থেকে আসা আসাদুল ইসলাম। কী হয়েছে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, আমার পাসপোর্ট আবেদনে এনআইডি কার্ডের সঙ্গে বাবা মায়ের নামের মিল নেই। এটা ঠিক করতে স্যারের কাছে যাচ্ছি। 

এ সময় আসাদুল ইসলামের সঙ্গে উপপরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করে প্রতিবেদক। সমস্যা সমাধানের একপর্যায়ে পাসপোর্ট অফিসের ওই কর্মকর্তা আসাদুল ইসলামের কাছে বিভিন্ন তথ্য জানতে চান। আসাদুল ইসলাম বলেন, তিনি শ্যামনগরের মাইক্রোস্ট্যান্ডে অবস্থিত মা ডিজিটাল স্টুডিও মালিক উৎপল মন্ডলের কাছ থেকে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন করেন।

আসাদুল ইসলাম বলেন, আমার মামার পরিচিত হওয়ায় উৎপল মন্ডলের কাছে আমি পাসপোর্ট করতে যাই। তিনি আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট বাবদ সাড়ে ৬ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে এসে জানতে পেরেছি আমার পাসপোর্ট এর জন্য ৫ হাজার ৭৫০ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অনলাইন আবেদনে উৎপল মন্ডল আমার বাবা-মায়ের নাম ভুল দিয়ে আমাকে হয়রানি করেছে। 

এদিকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে উৎপল মণ্ডলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বললে তিনি প্রথমে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়ে অস্বীকার করেন। একপর্যায়ে বিষয়টি স্বীকার করে উৎপল মন্ডল বলেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়েছে।

পরবর্তীতে, শ্যামনগরের ধুনঘাট এলাকা থেকে পাসপোর্ট করতে আসা সবুজ গাইন জানান, তিনিও উৎপল মন্ডলের মাধ্যমে অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন করেছেন। তার কাছ থেকে পাসপোর্টের সরকারি খরচ হিসাবে সর্বমোট সাড়ে ৬ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার টাকা পাসপোর্ট বাবদ এবং মা-বাবার নামের সংশোধন বাবদ ৫শ টাকা নেওয়া হয়েছে। 

এদিকে, পাসপোর্ট অফিস ও আশপাশের বিভিন্ন দালাল এবং পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে দালালদের কাছ থেকে পাসপোর্ট তৈরির একটি মূল্য তালিকা পেয়েছে প্রতিবেদক। মূল্য তালিকা অনুযায়ী দালালের মাধ্যমে ১০ বছরমেয়াদি পাসপোর্ট করতে গুনতে হবে লোক বিশেষ ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা। আবার ১০ বছর মেয়াদে জরুরি পাসপোর্ট করতে দালালকে দিতে হবে ১১ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। যেখানে ১০ বছরের পাসপোর্ট করতে সরকারি ব্যাংক ড্রাফট ফিস নির্ধারণ করা ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, জরুরি পাসপোর্টের সরকারি ফিস ৮ হাজার ৫০ টাকা। আবার দালালের মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদের পাসপোর্ট করতে দিতে হবে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা, যেখানে সরকারি ফিস ৪ হাজার ২৫ টাকা। পাঁচ বছরের জরুরি পাসপোর্ট করতে দালালকে দিতে হবে ৯ হাজার টাকা, যেখানে সরকারি ব্যাংক ড্রাফট নির্ধারণ করা ৬ হাজার ৩৫০ টাকা।

পাসপোর্ট করতে আসা কলারোয়া উপজেলার ঝিকরা গ্রাম থেকে আসা রহিমা খাতুন বলেন, আমি আমার বোনের ছেলে রাহুল মিয়ার পাসপোর্ট করতে এসেছি। কলারোয়া বাজারের ইমন কম্পিউটার থেকে আমরা পাসপোর্টের আবেদন করেছি। কম্পিউটারের দোকানদার ইমনের সঙ্গে ৯ হাজার টাকা চুক্তিতে আমরা পাসপোর্ট করতে এসেছি। ইতোমধ্যে ৮ হাজার টাকা দিয়েছি পরে এক হাজার টাকা দিতে হবে। 

এসব বিষয়ে জানতে ইমন কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী ইমনের সঙ্গে মুঠোফোনে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন এবং ব্যস্ত আছি বলে ফোন কেটে দেন। 

আশাশুনি উপজেলার পুইজালা এলাকা থেকে পাসপোর্ট করতে আসা স্বপন কুমার মন্ডল বলেন, পুইজালা বাজারের মিঠুনের মাধ্যমে আমি পাসপোর্ট করতে এসেছি। খরচ বাবদ মিঠুন আমার কাছ থেকে ৬ হাজার ৬০০ টাকা নিয়েছে। এরমধ্যে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাবদ নয়শ টাকা, বাকি টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হবে বলে সে আমাকে জানিয়েছে। 

স্থানীয় সংবাদকর্মী মোস্তফা রায়হান সিদ্দিকী বলেন, কয়েক বছরের মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের পাশেই গড়ে উঠেছে ১০টির মতো দোকান। এই দোকান থেকে পাসপোর্ট ফরম পূরণের পরে গ্রাহককে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হওয়ার কথা বিভিন্ন সময়ে শোনা যায়। 

তিনি বলেন, জেলা শহর ও আশপাশের এলাকার সাধারণ মানুষ মনে করেন পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন এসব দোকানগুলো থেকেই পাসপোর্টের ফরম পূরণ করতে হয়। অফিসে গিয়ে শুধু ফিঙ্গার এবং ছবি তোলা হয়। এ জন্য এসব দোকান থেকেই মানুষ নিজের অজান্তেই হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। 

পাসপোর্ট করতে আসা সজল চরন্দ আচার্জি বলেন, আমি একজন পুরোহিত। আমার বাসা নোয়াখালী জেলায়, বর্তমানে আমি সাতক্ষীরাতেই থাকি। পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন দোকান থেকে আমি পাসপোর্টের আবেদন করেছি। তিনি আমাকে বলেন, ৯ হাজার টাকা দিলে আমি সময় মতো পাসপোর্ট পেয়ে যাব। পরবর্তীতে কথাবার্তা বলে আমার কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে এসে জানতে পেরেছি পাসপোর্ট বাবদ ৫ হাজার ৭৫০ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে।  

সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক মো. আজমল কবির বলেন, সম্প্রতি আমি সাতক্ষীরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যোগদান করেছি। যোগদানের পর থেকেই কোনো প্রকার হয়রানি ছাড়াই সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে এসবের মধ্যেও দালালরা বিভিন্ন কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমরা পাসপোর্ট করতে আসা বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, দালালরা পাসপোর্ট অফিস ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। 

তিনি বলেন, নিয়মিত মোবাইল কোর্ট করে দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর চিঠি দিয়েছি। আশা করি, সবার সহযোগিতা পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে দালাল দমন করতে সক্ষম হব।

সাতক্ষীরা জেলা পুলিশের ডিএসবি শাখার উপপরিদর্শক (ডিআইও-১) মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য কোনো টাকা পয়সা লাগে না। কেউ বলতে পারবে না ভেরিফিকেশনের জন্য পুলিশ তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। আর যদি পুলিশের নাম করে কেউ টাকা নিয়ে থাকে আমরা অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।

Read Entire Article