‘বন্ধু ট্রাম্পকে’ ছেড়ে পুতিন-জিনপিংয়ের হাত ধরছেন মোদী

1 month ago 13

শুল্ক নিয়ে বাণিজ্য হুমকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চরম উত্তেজনার মধ্যে কৌশলগতভাবে চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাশিয়া থেকে তেল কেনা নিয়ে ওয়াশিংটনের শুল্ক হুমকি ও প্রকাশ্য ক্ষোভের পরপরই তিনি চীন সফরে যাচ্ছেন এবং তার আগে রাশিয়ায় পাঠাচ্ছেন শীর্ষ দুই নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র কর্মকর্তাকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ওয়াশিংটনের চাপে ভারসাম্য রক্ষায় নয়াদিল্লির কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত।

আগামী ৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনের তিয়ানজিন শহরে অনুষ্ঠিতব্য সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে চীন সফরে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। এটি ২০২০ সালে গালওয়ান উপত্যকায় চীন-ভারত সেনা সংঘর্ষের পর মোদীর প্রথম চীন সফর। সবশেষ ২০১৯ সালে তিনি চীনে গিয়েছিলেন। যদিও ২০২৪ সালের অক্টোবরে ব্রিকস সম্মেলনে রাশিয়ার কাজানে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছিলেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি

চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের এই উদ্যোগটি এমন এক সময় নেওয়া হচ্ছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি চালিয়ে যাওয়ায় বুধবার (৬ আগস্ট) ভারতের ওপর আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ফলে দেশটির ওপর মোট শুল্ক হার দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বড় বাণিজ্য অংশীদারের ওপর অন্যতম সর্বোচ্চ শুল্কহার।

ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে অভিযোগ করেন, ভারত বিপুল পরিমাণ রাশিয়ান তেল আমদানি করছে এবং তা বাজারে বিক্রি করে মুনাফা করছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য নয়। নিজস্ব সামাজিকমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে তিনি বলেন, তারা (ভারত) যুদ্ধের কারণে মানুষ মরছে কিনা, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।

এমনকি, সিএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ভারত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপকারী দেশ। আমি ২৫ শতাংশে স্থির ছিলাম, কিন্তু আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও বাড়িয়ে দেবো। হোয়াইট হাউজ থেকে জানানো হয়েছে, নতুন শুল্ক ৮ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।

রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ জোরদার

যুক্তরাষ্ট্রের এই চাপের মধ্যেই মোদী রাশিয়ায় পাঠাচ্ছেন তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করকে। দোভাল বুধবার (৬ আগস্ট) মস্কোর উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন ও বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রুশ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সফরটি পূর্বনির্ধারিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এর তাৎপর্য অনেক বেড়ে গেছে।

বিশেষ সূত্রগুলো বলছে, দোভালের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সরাসরি বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তাদের আলোচনায় প্রধান বিষয় হতে পারে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল সরবরাহ, এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাকি ইউনিট হস্তান্তর ও আফগানিস্তান পরিস্থিতি। রুশ বার্তা সংস্থা তাস জানায়, বর্তমান জরুরি ভূরাজনৈতিক ইস্যুজ্বালানি সরবরাহ বিষয়টি দোভালের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।

অন্যদিকে, আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে ভারত-রাশিয়া আন্তঃসরকার কমিশনের বৈঠকে অংশ নিতে মস্কো যাবেন জয়শঙ্কর। এই কমিশন বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক সহযোগিতা পর্যালোচনা করে থাকে। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকির প্রেক্ষাপটে এই বৈঠকটিও অত্যন্ত কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

চীন সফরে ভারসাম্য রাজনীতি

চীন সফরে এসসিও সম্মেলনে মোদীর উপস্থিতি কেবল প্রতীকী নয় বরং কৌশলগত বার্তাও বহন করে। সীমান্ত উত্তেজনা কমানো ও চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সংলাপ শুরুর সম্ভাবনাও রয়েছে। বিশেষ করে, শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মোদীর একটি আলাদা বৈঠক নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে। এই বৈঠক সফল হলে তা ভারতের চীন সংক্রান্ত নীতিতে নতুন মোড় আনতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

তাছাড়া রাশিয়ার সঙ্গেও মোদীর বৈঠক হতে পারে, যা ভারত-রাশিয়া-চীন সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করতে পারে ও যুক্তরাষ্ট্রের একক বলয়ের বাইরে বেরিয়ে আসার বার্তা দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

বন্ধুত্বের’ নতুন সংজ্ঞা?

নরেন্দ্র মোদী ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে একসময় ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টেক্সাসের হিউস্টনেহাউডি মোদী ২০২০ সালে ভারতের আহমেদাবাদে নামাস্তে ট্রাম্প আয়োজন সেই সম্পর্কেরই বহিঃপ্রকাশ ছিল। কিন্তু ২০২৫ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও একতরফা অবস্থানের কারণে দুই দেশের কৌশলগত দূরত্ব বাড়ছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

বিশ্লেষকদের মতে, মোদীর সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো কেবল প্রতিক্রিয়াশীল নয় বরং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রস্তুতির অংশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যের বাইরে বিকল্প মিত্রতা গড়ে তোলাই হয়তো মূল লক্ষ্য।

সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস, এনডিটিভি, রয়টার্স

এসএএইচ

Read Entire Article