পিঠা বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পিঠার নাম শুনলে জিভে পানি আসে না, এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু শহুরে সংস্কৃতির দাপটে পিঠার অবস্থান যেন দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে মাঘের শেষ দিনে বসন্ত বরণ ও পিঠা বেশ ঘটা করেই উদযাপন করল খিলগাঁও মডেল কলেজ।
বৃহস্পতিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দিনব্যাপী খিলগাঁও মডেল কলেজ ক্যাম্পাস চত্বরজুড়ে বসন্তবরণ ও পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষের আয়োজনে অনুষ্ঠানে হরেক রকমের পিঠার পসরা নিয়ে বিভিন্ন স্টল সাজান শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ছিল মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক আয়োজন।
উৎসবে কলেজের বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, প্রাণীবিদ্যা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইংরেজি, গণিত, মার্কেটিং, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ ছাড়াও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা ১৫টি স্টল দেয়। স্টলগুলোতে ভাপা, ছাঁচ, ছিটকা, চিতই, দুধ চিতই, বিবিখানা, চুটকি, চাপড়ি, চাঁদ পাকন, সুন্দরী পাকান, সরভাজা, পুলি, পাটিসাপটা, পানতোয়া, মালপোয়া, আন্দশা, কুলশি, লবঙ্গ লতিকা পিঠা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পায়েস ও সেমাই, মুড়ি ও চিড়ার মোয়া, ফিরনি ইত্যাদি সারি সারি সাজিয়ে দিনভর চলে প্রদর্শন ও ক্রয়-বিক্রয়।
সকাল ১১টায় অনুষ্ঠান উদ্বোধনের পর আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন অধ্যক্ষ প্রফেসর ইমাম জাফর। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
এ সময় তিনি বলেন, বঙালির ইতিহাস সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বসন্তবরণ ও পিঠা উৎসবের এই আয়োজন। আমরা চাই শহরের মানুষ হয়েও আমাদের শিক্ষার্থীরা গ্রামের মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিক। ধরে রাখুক বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য।
অধ্যক্ষ ইমাম জাফর বলেন, শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার পাশাপাশি সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে খিলগাঁও মডেল কলেজ প্রায়ই এমন আয়োজন করে থাকে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা বৈষম্যহীন, মানবিক একটি জাতি চাই। যেমনটা স্বপ্ন দেখে ২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের ছাত্র-জনতা, তরুণরা।
তিনি আরও বলেন, খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষার্থীরা গণআন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, গুরুতর আহত হয়েছে; কলেজ ক্যাম্পাসে গণহত্যার দিনগুলোর গুলির দাগ এখনো বিদ্যমান। জাতির ক্রান্তিলগ্নে আমার ছাত্ররা যে ভূমিকা রেখেছে সেটি আমাকে গর্বিত করেছে। তবে তাদের আন্দোলনের সাফল্য ধরে রাখতে হলে এখন ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নিতে হবে। আর সেজন্য পড়াশোনা, মেধার বিকাশ ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করার বিকল্প নেই।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি বিশেষ করে ইন্টারনেটও মোবাইল নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু খিলগাঁও মডেল কলেজের এই আয়োজন শিক্ষার্থীদের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ততার বাইরে নতুন কিছু শেখাবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের আয়োজন প্রায়ই হওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, এতে সমাজিকতা শেখে, সৃজনশীল দক্ষতা বাড়ে, সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে এতে মানুষ হিসেবে মানবিক মর্যাবোধও বিকশিত হয়।
মানবিকতা, মূল্যবোধের শিক্ষা সম্পন্ন সুনাগরিক ছাড়া দেশ পরিবর্তন হয় না মন্তব্য করে চৌধুরী মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির আরও বলেন, সম্প্রতি আমরা আয়নাঘরের বীভৎসতা আমাদের সামনে এসেছে। মানুষ এতটা অসভ্য, বর্বর ও নৃশংস হয় কি করে? আমাদের দেশের মানুষ তো এমন না! দেশে আয়নাঘরের মতো এমন নির্যাতনকেন্দ্র থাকতে পারে, সেটা আমি ভাবতেও পারি না। এত বীভৎস মানসিকতা কীভাবে তৈরি হয়েছে? কেবল আমরা শেকড় থেকে দূরে চলে গেছি বলেই। আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির এমনটা শেখায় না। তাই এ ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। কেননা আজকের শিক্ষার্থীরা, আজকের তরুণরা আগামী দিনে দেশের হাল ধরবে। যেমনটা ধরেছিল মুক্তিযুদ্ধে, জুলাই বিপ্লবে।
অনুষ্ঠানে কলেজের হিতৈষী সদস্য মামুনুর রশীদ আখন্দ, বিদ্যুৎসাহী সদস্য মাহফুজুর রহমান মাহফুজ, দাতা সদস্য হানিফ মাহমুদ, কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি কে এম নাহিদ হাসান, ১ নং ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি এম জামান ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা উপস্থিত ছিলেন।