যদি আপনাকে বলা হয়, 'ডান মানেই সঠিক, বাঁ মানেই ভুল' তাহলে কি আপনি বিশ্বাস করবেন?
কথাগুলো শত বছরের পুরনো রীতি, যা মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকে বসে আছে। ইংরেজিতে 'রাইট' মানে শুধু ডান নয়, বরং সঠিকও। আর 'লেফট' এসেছে এক পুরনো শব্দ থেকে, যার মানে দুর্বল। লাতিন ভাষায় 'সিনিস্টার' মানে বাঁ – যেটা আবার অশুভের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
তবুও কিছু মানুষ আছেন, যারা বাঁ দিক দিয়েই পৃথিবীকে আঁকেন, লেখেন, ধরেন, গড়েন। যেন নিয়মের বাইরে হাঁটার জন্যই তারা জন্মেছেন। তাদের হাত যখন কাগজ ছোঁয়, মনে হয় বর্ণমালা অন্যভাবে নাচে। যখন তারা বল ছোঁড়েন, প্রতিপক্ষ বিভ্রান্ত হয়। যখন তারা ছবি আঁকেন, তাতে এক অদ্ভুত গভীরতা থাকে। আজ ১৩ আগস্ট, আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবস। দিনটি তাদের জন্যই, তাদের নিয়েই কথা বলবো আজ।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ওপ্রাহ উইনফ্রে, আলবার্ট আইনস্টাইন, বারাক ওবামা
দুনিয়ার অধিকাংশ সরঞ্জাম, আসবাব, এমনকি লেখা-পড়ার খাতাও ডিজাইন হয় ডানহাতিদের কথা ভেবে। তবুও বাঁহাতিরা সেসব বাধা পার হয়ে এগিয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতায় তারা রেখে গেছে এমন সব চিহ্ন, যা পৃথিবীকে অবাক করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের তালিকায় একদল বাঁহাতি শাসক রয়েছেন। যেমন - রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ বুশ, বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা।
ব্রিটিশ রাজপরিবারেও বাঁ হাতের ছাপ স্পষ্ট। প্রিন্স উইলিয়াম, তার পূর্বপুরুষ রাজা জর্জ ষষ্ঠ – যিনি আসলে বাঁহাতি ছিলেন, কিন্তু বাবার চাপে ডান হাতে লিখতে শিখতে হয়েছিল। যেন রাজনীতি আর রাজকীয়তা, দুই ক্ষেত্রেই বাঁ হাত নীরবে নিজের ক্ষমতার ছাপ রেখেছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলে, বাঁহাতিদের মস্তিষ্কের দুই পাশের মধ্যে সংযোগ ডানহাতিদের তুলনায় বেশি। ডান মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে বাঁ হাত, আর সেই ডান মস্তিষ্কই সৃজনশীলতা, কল্পনা আর সঙ্গীতের রঙিন দিকগুলোকে জাগিয়ে রাখে। তাই হয়তো লেওনার্দো দা ভিঞ্চির হাতে জন্ম নিয়েছিল মোনালিসা, আর মাইকেলেঞ্জেলোর হাতে উঠেছিল সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদ। তারা পৃথিবীকে দেখেছেন ভিন্নভাবে। হয়তো এজন্যই বাঁহাতিদের চিন্তায় প্রায়ই একধরনের অপ্রত্যাশিত বাঁক থাকে।
যুবরাজ সিং, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি
তবে সব জায়গায় এই বাঁ হাতের গল্প মুক্তভাবে বলা যায় না। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ইন্দোনেশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশে বাঁ হাত দিয়ে কিছু ধরা বা দেয়া এখনও 'অশোভন' বলে ধরা হয়। ছোটবেলায় অনেক বাঁহাতি শিশুকে বলা হয়, 'ডান হাতে ধরো পেনসিল।' কিন্তু প্রতিভা কি হাতে ধরা নিয়মে আটকায়? কেউ কেউ চাপে ডান হাত শিখে নেন, আবার কেউ হন অ্যাম্বিডেক্সট্রাস বা দুই হাতেই সমান দক্ষ।
সাকিব আল হাসান
খেলাধুলায় বাঁহাতিদের উপস্থিতি যেন প্রতিপক্ষের জন্য অজানা ধাঁধা। ক্রিকেটে ব্রায়ান লারা, ওয়াসিম আকরাম, যুবরাজ সিং, সাকিব আল হাসান তাদের বাঁ হাতই জিতিয়েছে ম্যাচ। যেন তাদের 'বাঁ হাতের খেলা'। টেনিসে রাফায়েল নাদালের র্যাকেটের ঘূর্ণি, ফুটবলে মেসি বা ম্যারাডোনার বাঁ পায়ের শট – সবই যেন এক অপ্রত্যাশিত কোণ থেকে আসা আঘাত।
পরিসংখ্যান বলে, পাশ্চাত্যে গাড়ি চালানোর পরীক্ষায় প্রথমবারেই উত্তীর্ণ হওয়া ড্রাইভারদের মধ্যে বাঁহাতিদের হার শতকরা ৫৭ ভাগ ও ডানহাতিদের ৪৭ ভাগের চেয়ে বেশি। তাদের মধ্যে দ্রুত টাইপ করা, একসঙ্গে একাধিক কাজ সামলানো, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা, এমনকি গড় আয়ে এগিয়ে থাকা; এসব বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়।
মার্ক জাকারবার্গ, বিল গেটস
বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, আইনস্টাইন, অ্যারিস্টটল, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, টম ক্রুজ, ওপ্রাহ উইনফ্রে, লেডি গাগা, পল ম্যাককার্টনি তালিকা যেন শেষ হতে চায় না। গায়ক জাস্টিন বিবার একসময় ডানহাতিদের গিটার উল্টিয়ে বাজাতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছিলেন। পরে মা তাকে দিলেন বাঁহাতিদের জন্য বানানো গিটার, সেখান থেকেই শুরু তার সঙ্গীতজয়।
জাস্টিন বিবার, ওয়াসিম আকরাম
১৯৭৬ সালে ডি. আর. ক্যাম্পবেল 'লেফট হ্যান্ডার্স ক্লাব' প্রতিষ্ঠা করে এই দিনটি উদযাপন শুরু করেন। ১৯৯২ সাল থেকে বড় পরিসরে পালিত হতে থাকে। উদ্দেশ্য বাঁহাতিদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা, এবং 'ডানহাতি প্রধান' পৃথিবীতে বাঁহাতিদের স্বাতন্ত্র্যকে উদযাপন করা।
বিশ্বের মাত্র শতকরা ১০-১২ ভাগ মানুষ বাঁহাতি। সংখ্যায় তারা কম, কিন্তু প্রভাবের দিক থেকে? রাজনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, খেলাধুলা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের ছাপ স্পষ্ট। হয়তো সংখ্যায় সংখ্যালঘু, কিন্তু ভাবনায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
তবে আন্তর্জাতিক বাঁহাতি দিবসে একটা প্রশ্নটা থেকেই যায় – বাঁ হাত কি শুধু একধরনের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ভিন্ন এক চিন্তার ধারা? যদি আপনি বাঁহাতি হন, হয়তো উত্তরটা আপনি ইতিমধ্যেই জানেন – আপনার ডানপাশের মস্তিষ্কের মাধ্যমে!
সূত্র: বিবিসি, হেলথওয়্যার, সিএনএন, ডেজ অব দ্য ইয়ার।
এএমপি/জিকেএস