বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প দেশের ডিমের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডিম একটি মৌলিক খাদ্য উপকরণ হওয়ায় এর মূল্য ও সরবরাহে স্থিতিশীলতা অটুট রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডিমের বাজারে বিভিন্ন সমস্যার কারণে এর মূল্য বেড়ে গেছে এবং সরবরাহে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে ডিমের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও নীতিগত দিক পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহের সমতা রক্ষা, উৎপাদন ব্যয়ের নিয়ন্ত্রণ, এবং আমদানি নীতি যথাযথভাবে পরিচালনার মাধ্যমে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব। ডিমের বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট সমস্যা সমাধানে সুপারিশমালা তুলে ধরতে নিম্নলিখিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো।
ডিমের চাহিদা ও উৎপাদন: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বর্তমানে (২০২২-২৩) দেশে ডিমের বাৎসরিক চাহিদা ১৮০৬.৪৮ কোটি, উৎপাদন ২৩৩৭.৬৩ কোটি, মাথা পিছু ডিম ১০৪ টি, মাথাপিছু ডিমের যোগান আছে ১৩৪.৫৮ টি। (দেশের জনসংখ্যা জুলাই, ২০২২ পর্যন্ত ১৭ কোটি ৩৭ লক্ষ হিসাব করে।
পোল্ট্রি ফিডের কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার: সরকার নিবন্ধিত হাঁস-মুরগির খামার কর্তৃক আমদানিকৃত উপকরণের রেয়াতী সুবিধা দ্বয়ের মাধ্যমে হাঁস-মুরগির খামার স্থাপনে যেসকল যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও উপকরণ প্রয়োজন হয় সেসকল উপকরণ ও হাঁস-মুরগি, মৎস্য ও গবাদি পশুর খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানিতে সকল প্রকার শুল্ক ও কর অব্যাহতি প্রদান করেছে। এর ফলে খামার স্থাপন এবং খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ এবং খাদ্যের কাঁচামাল আমাদানিতে কোন প্রকার শুল্ক প্রদান করতে হয় না।
পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে ডিমের মূল্য স্থানীয় বাজার মূল্যের তুলনা: বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ডিমের মূল্যের তুলনা নিন্মের সারণীতে প্রদত্তঃ
পণ্যের নাম |
ভারত (প্রতি পিস) |
পাকিস্তান (প্রতি পিস) |
বাংলাদেশ (প্রতি পিস) |
মুরগীর ডিম |
৬.৭৫-৮.০০ টাকা |
৬.০৮- ৯.৮৩ টাকা |
১২.৫-১৩.৭৫ |
ভারতীয় (১.৪১ টাকা = ১ রুপি ধরে), পাকিস্তানি (১ টাকা= ০.৪২ রুপি ধরে) (২ জুন, ২০২৪) অনু্যায়ী।
সরকারি নীতি সহায়তা: সরকার দেশে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ তরান্বিত করার লক্ষ্যে রাজস্ব নীতির মাধ্যমে বিদেশ থেকে ডিম আমদানিতে উচ্চহারে শুল্কারোপপূর্বক আমাদানি নিরুৎসাহিত করে স্থানীয় পোল্ট্রি শিল্পকে সুরক্ষা প্রদান করেছে। এছাড়া, পোল্ট্রি শিল্পের স্থানীয় উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে এ শিল্প স্থাপনে সকল প্রকার মূলধনী যন্ত্রপাতি, খামার শেড স্থাপনে ব্যবহৃত উপকরণ, ঔষধ, ভ্যাকসিন, ভিটামিন, প্রিমিক্স এছাড়া পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত সকল উপকরণ আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি প্রদান করেছে এবং বিদেশ থেকে পোল্ট্রি ফিডের বাণিজ্যিক আমদানি নিরুৎসাহিতকরণে সম্পূর্ণায়িত ফিড আমদানিতে ১০% কাস্টমস ডিউটি (সিডি)-সহ মোট ১৭.৫০% শুল্ক সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। রাজস্ব নীতির বাহিরেও সরকার স্থানীয় এ শিল্প সুরক্ষায় বিদ্যমান আমদানি নীতি আদেশ, ২০২১-২০২৪ এর বিভিন্ন অনুচ্ছেদ ও উপানুচ্ছেদের মাধ্যমে পোল্ট্রি খাদ্য, পোল্ট্রি মুরগি ও মুরগির ডিম আমদানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার শর্তারোপ করে আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সরকারি নীতি সহায়তার ফলে স্থানীয় পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ তরান্বিত হওয়ায় মুরগির মাংস ও ডিমের স্থানীয় চাহিদাতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছে।
সরকারি নীতি সহায়তার নেতিবাচক প্রভাব: সরকার স্থানীয় পোল্ট্রি শিল্প সুরক্ষায় নীতি সহায়তা প্রদান করার পাশাপাশি শিল্পের পশ্চাৎপদ শিল্প (Backward Linkage Industries)-কেও অতিমাত্রায় সুরক্ষা প্রদান করায় আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অপেক্ষা স্থানীভাবে উৎপাদিত পোল্ট্রি খাদ্যের মূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশ্ববর্তী দেশসমূহের ডিমের যে উৎপাদন মূল্য তা স্থানীয় মূল্য অপেক্ষা অনেক কম।
ডিমের উৎপাদন মূল্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডিম উৎপাদনে মোট খরচের ৭৫%-৮৯% পর্যন্ত খরচ হয় পোল্ট্রি/লেয়ার ফিডের মূল্যের উপর। পাশ্ববর্তী দেশসমূহে লেয়ার ফিডের যে মূল্য তা স্থানীয় মূল্য অপেক্ষা কম। এছাড়া,ডিম উৎপাদনের জন্য ০১ দিনের মুরগির বাচ্চার যে মূল্য তাও অন্যান্য দেশ অপেক্ষা বেশি। এধরনের মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্পের পাশাপাশি এ শিল্পের পশ্চাৎপদ শিল্প (Backward Linkage Industries)-কে অতিমাত্রায় সুরক্ষা প্রদান।
পর্যবেক্ষণ: উপর্যুক্ত পর্যালোচনার কমিশনের পর্যবেক্ষণ নিন্মরূপঃ
(1). দেশে ডিমের বাৎসরিক চাহিদা ১৮০৬.৪৮ কোটি, উৎপাদন ২৩৩৭.৬৩ কোটি, মাথা পিছু ডিম ১০৪ টি, মাথাপিছু ডিমের যোগান আছে ১৩৪.৫৮ টি;
(2). ডিমের উতপাদন খরচ পর্যালোচনায় দেখা যায় স্থানিয়ভাবে একটি ডিমের উৎপাদন ব্যায়ে খাদ্য বাবদ খরচ হয় ৯.৬৬ টাকা যা মোট ব্যায়ের প্রভাব ৭৮%;
(3). ডিম আমদানিতে মোট 33% শুল্ক আরোপিত আছে;
(4). পশু খাদ্য আমদানিতে মোট শুল্ক ১০% সিডিসহ মোট ১৭.৫০% শুল্কারোপিত আছে;
(5). হাঁস-মুরগির খামার স্থাপনে যেসকল যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও উপকরণ প্রয়োজন হয় সেসকল উপকরণ আমদানিতে শুল্ক রেয়াতি সুবিধা প্রদান করা হয়েছে;
(6). বিদ্যমান আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী পশুখাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কমপ্লায়েন্স শর্তারোপ করেও আমদানির ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে;
(7). সরকার স্থানীয় পোল্ট্রি শিল্প সুরক্ষায় নীতি সহায়তা প্রদান করার পাশাপাশি শিল্পের পশ্চাৎপদ শিল্প (Backward Linkage Industries)-কেও অতিমাত্রায় সুরক্ষা প্রদান করায় আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অপেক্ষা স্থানীভাবে উৎপাদিত পোল্ট্রি খাদ্যের মূল্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে;
(8). পার্শবর্তী দেশ ভারতে ডিমের মূল্য বাংলাদেশ থেকে ৪০% কম থাকায় ভারত থেকে ডিমের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য উৎসাহিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে;
(9). পাশ্ববর্তী দেশসমূহে লেয়ার ফিডের যে মূল্য তা স্থানীয় মূল্য অপেক্ষা ৩০% থেকে ৩৫%কম;
(10). পাশ্ববর্তী দেশসমূহে একদিনের মুরগির বাচ্চার যে মূল্য তা স্থানীয় মূল্য অপেক্ষা ৩৫% থেকে ৪০% কম;
(11). স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ইনপুট-আউটপুট কো-এফিশিয়েন্ট পর্যালোচনায় দেখা যায় স্থানিয়ভাবে উৎপাদিত পোল্ট্রি ফিডের যে উপকরণ মূল্য সে মূল্যে পার্শবর্তী দেশ সমূহে সম্পূর্ণায়িত পণ্য বিক্রয় হচ্ছে।
সুপারিশ:
(1). পোল্ট্রি খাদ্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড খাদ্য উৎপাদনকারী মিল সমূহের ইনপুট-আউটপুট কো-এফিশিয়েন্ট পর্যালোচনা করতে পারে;
(2). আমদানি নীতি আদেশে পোল্ট্রি খাদ্য আমদানিতে খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করণে আন্তর্জাতিক মান সংক্রান্ত সকল শর্তারোপ করা হয়েছে তাই পোল্ট্রি ফিড আমদানির ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দেয়া যেতে পারে;
(3). পোল্ট্রি ফিডের সকল উপাদান আমদানিতে শুল্কছাড় দিয়েও যেহেতু পোল্ট্রি খাদ্যের স্থানীয় উৎপাদন মূল্য বেশী তাই স্থানীয় বাজারে পোল্ট্রি খাদ্যের মূল্য স্থিতিশীল করণে পোল্ট্রি ফিড আমদানিতে বিদ্যমান (সিডি) ১০% থেকে হ্রাস করে ৫% করা যেতে পারে;
(4). ডিম আমদানিতে আমদানি শুল্ক (সিডি) ২৫% থেকে হ্রাস করে ১৫% করা যেতে পারে;
(5). একদিনের মুরগীর বাচ্চার স্থানীয় উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের নিমিত্ত বাংলাদেশ প্রাণি সম্পদ গবেষনা ইন্সটিটিউট মুরগীর বাচ্চার উৎপাদন ব্যয় পর্যালোচনা করতে পারে; ও
(6). স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল করণে ডিম উৎপাদন পরবর্তী সরবরাহ ব্যবস্থা (খামার থেকে ভোক্তা) এর উপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা যেতে পারে।
ডিমের বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে যথাযথ নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি। এটি দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা ও খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : পরিচালক , ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ।
এইচআর/এএসএম