বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশে বড় কোনো অগ্রগতি নেই: বিবিএক্স জরিপ

6 hours ago 2

বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশে গত এক বছরে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি; বরং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স বা ব্যবসা জলবায়ু সূচকের (বিবিএক্স) সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বিবিএক্স জরিপের চতুর্থ সংস্করণটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ। উদ্যোগটিকে সহায়তা করেছে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি)।

প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) বিকেলে গুলশানে এমসিসিআই কার্যালয়ে প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ৮০০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৫০টি প্রতিষ্ঠান জরিপে অংশ নেয়, যার আওতায় ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় ব্যবসা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বিবিএক্স প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিয়ন্ত্রক তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো, শ্রমনীতি, বাণিজ্য সুবিধা, প্রযুক্তি গ্রহণ, পরিবেশগত মান রক্ষা—এসব ক্ষেত্রেই আগের বছরের তুলনায় সূচকের মান কমেছে।

তবে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসার পরিবেশ সূচক ৫৯ দশমিক ৬৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে, যা আগের অর্থবছরের ৫৮ দশমিক ৭৫ পয়েন্ট থেকে সামান্য বেড়েছে। মাত্র ০.৯৪ পয়েন্ট বৃদ্ধিকে বিশেষ কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে দেখা যাচ্ছে না।

 বিবিএক্স জরিপ

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি ও মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা—এসবই বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। গত অর্থবছরে সূচকটি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল, যেখানে তার আগের দুই বছর ছিল ৬১ পয়েন্টের ওপরে।

জরিপে দেশের ১২টি খাত অন্তর্ভুক্ত করা হয়—খুচরা ও পাইকারি বাণিজ্য, পরিবহন, নির্মাণ, ইলেকট্রনিক্স ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, চামড়া ও ট্যানারি, কৃষি ও বনজ, রিয়েল এস্টেট, খাদ্য ও পানীয়, ওষুধ ও রাসায়নিক, তৈরি পোশাক, বস্ত্র ও আর্থিক মধ্যস্থতা।

অনুষ্ঠানে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. মসরুর রিয়াজ বলেন, ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে এখনই সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

জরিপে ১১টি মূল স্তম্ভ ধরে সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে—ব্যবসা শুরু, ভূমি প্রাপ্তি, নিয়ন্ত্রক তথ্য, অবকাঠামো, শ্রমনীতি, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্য সুবিধা, কর প্রদান, প্রযুক্তি গ্রহণ, অর্থায়ন ও পরিবেশ বিধিমালা।

ড. মসরুর রিয়াজ জানান, ঢাকা ও চট্টগ্রাম দেশের ব্যবসার ৫৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ দুই শহরে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি হয়নি। নতুন ব্যবসা শুরু করাও এখানকার বড় চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, সিলেট ১১টির মধ্যে ৪টি স্তম্ভে এবং বরিশাল ৩টি স্তম্ভে শীর্ষে রয়েছে।

৭৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি ও আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক, ওষুধ ও পাইকারি বাণিজ্যে। ৫৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে এবং ৬০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সমস্যায় পড়েছে।

ড. রিয়াজ বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা অনেক সময় সমস্যাগুলো স্বীকার করেন, তবে সেগুলো সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিবিএক্স তথ্য ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সরকারকে সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করবে বলেও জানান তিনি।

অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজুআকি কাটাওকা, বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের এমডি রূপালি চৌধুরী প্রমুখ।

এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি. রহমান বলেন, বিবিএক্স বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা প্রতিফলিত করে। নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স। তিনি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটালাইজেশন, অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, আমলাতান্ত্রিক সহযোগিতার ঘাটতি এখন বড় সমস্যা। অনেক কর্মকর্তা দায়িত্বহীনভাবে কাজ করছেন, যা ব্যবসার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতা বাড়ানো সম্ভব নয়।

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের এমডি রূপালি চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদেরও আইন ও বিধি মেনে চলতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান বছর বছর লোকসান দেখানোর কারণে ন্যূনতম কর আরোপ করতে হয়েছে। স্বচ্ছতা ও অটোমেশনই টেকসই উন্নয়নের পথ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ব্যাংক সুদের উচ্চ হার ব্যবসা পরিচালনায় বড় বাধা। আগামী বছরের শুরুতেই ঋণের সুদহার কিছুটা কমবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, অনেক ব্যবসায়ী রাজস্ব বোর্ডের অডিট নিয়ে অভিযোগ তুলছেন, কিন্তু অডিট পদ্ধতি সংস্কার করলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

তিনি বলেন, দুর্নীতি ব্যবসার পরিবেশের জন্য বড় বাধা। তবে দৃঢ় নজরদারি ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে এটি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন যেকোনো দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি জানাতে তিনি ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানান এবং আশ্বাস দেন যে সরকার সেগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।

এসএম/এমকেআর/জেআইএম

Read Entire Article