বাংলাদেশের মাটিতে ল্যাভেন্ডার চাষ করা সম্ভব

1 hour ago 1

মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার

ল্যাভেন্ডার এমন উদ্ভিদ, যা তার বিস্ময়কর ঘ্রাণ এবং ওষুধি গুণের জন্য বিশ্বে প্রশংসিত। বর্তমানে বাংলাদেশে ল্যাভেন্ডার চাষ এবং ব্যবহারের জন্য জমির পরিমাণ বেড়েছে বলে ধারণা করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। অর্থনৈতিকভাবেও শিল্প ও পর্যটনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ল্যাভেন্ডার একটি দীর্ঘস্থায়ী উদ্ভিদ, যা যে কোনো জলবায়ু মোকাবিলায় সক্ষম। যে কোনো মাটিতে চাষ করা সম্ভব। ল্যাভেন্ডারের ফুল ও তেল সুগন্ধি, ওষুধি ও পুষ্টিকর পণ্য তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ল্যাভেন্ডার চাষ অর্থ উপার্জনের বিভিন্ন রকম সুযোগ এনে দেয়।

ল্যাভেন্ডার চাষের সুবিধা হলো, এর গাছ বিভিন্ন ধরনের মাটিতে সহজে বেড়ে উঠতে পারে। ফুল ফোটাতে বেশি সময় লাগে না। তাই তাড়াতাড়ি ফসল ও অর্থনৈতিক সাফল্য পাওয়া যায়। এটি তেল, চা ও প্রসাধনী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যা মুনাফা অর্জনে অবাধ সুযোগ দেয়। বিশ্বজুড়েই ল্যাভেন্ডারের তৈরি পণ্য সৌখিন, ব্যয়বহুল ও বেশি জনপ্রিয়। চাষাবাদের পুরো এলাকাই পরিণত হয় পর্যটন কেন্দ্রে। এই গাছের ভালো বৃদ্ধি ও ফুল উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত সূর্যালোক ও সঠিক পানির প্রয়োজন। গাছের শাখা-প্রশাখা ছাঁটার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ এটি গাছের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

রোগ ও কীটপতঙ্গ সমস্যা সমাধানের ব্যপারে ল্যাভেন্ডারের সুবিধা হলো, এর তৈরি প্রসাধনী মানুষ সুগন্ধির পাশাপাশি ক্ষতিকারক পতঙ্গরোধেও ব্যবহার করে। বিশেষ করে মশা ও ছারপোকা রোধে ল্যাভেন্ডারের তেল খুবই কার্যকর ও জনপ্রিয়। যদিও এগুলো আমদানির কারণে দাম বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে এখনো ব্যবহার কম। তবে এরপরও মাঝেমাঝে কীটপতঙ্গ এবং রোগের সমস্যা দেখা দেয়। সঠিক পরিচর্যা ও কীটনাশক ব্যবহারে সমস্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ জন্য সমাধান ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্ভাব্য সমস্যাগুলো আগেভাগেই চিহ্নিত করে সমাধান গ্রহণ করতে হবে। উষ্ণ, শুষ্ক এবং সূর্যালোকপ্রাপ্ত স্থান ল্যাভেন্ডার চাষের জন্য বেশি উপযোগী।

ল্যাভেন্ডার বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। যা বিভিন্ন আবহাওয়া এবং মাটিতে চাষ করা যায়। যার জন্য নতুন সম্ভাবনাময় ফসল হিসেবে বাংলাদেশকেও এটি চাষের অনুপোযোগী বলা যায় না। এটি সহজে বাড়ে এবং ফুল ফোটাতে সময় লাগে না। চাষের জন্য ল্যাভেন্ডার চারাগাছ, উপযুক্ত মাটি এবং অন্যান্য সরঞ্জামের প্রয়োজন। সঠিক সেচব্যবস্থা ও ডাল ছাঁটার জন্য কাঁচি প্রয়োজন। সঠিক পরিমাণে পানি দেওয়া ও মাটির পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখা ল্যাভেন্ডারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গাছের ফুল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য শাখা-প্রশাখা ছাঁটার প্রয়োজন হয়। গাছের নিয়মিত যত্ন ও পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পর্যটন ও অর্থনীতি
ল্যাভেন্ডারের জন্য নেওয়া কৃষিজমি একাধিক আর্থিক সুবিধা দিতে পারে। ল্যাভেন্ডার থেকে তেল, ফুল, চা, সাবান এবং মোমবাতি তৈরি এবং বিক্রি করা যেতে পারে। যেসব দেশে প্রচুর ল্যাভেন্ডার চাষ হয়; সেখানে বাগান করার পরই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পর্যটন স্পট হয়ে যায়। এরপর পর্যটকদের জন্য অন্যান্য জোগান দেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। এটি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, খরা প্রতিরোধ ও মাটির পুষ্টিগুণ বাড়ায়। ল্যাভেন্ডার ফার্মকেন্দ্রিক পণ্য তৈরি শিল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন হোটেল, রিসোর্টসহ পর্যটনভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগকেও শক্তিশালী করে তোলে। এরপর গবেষণা করে আরও পণ্য তৈরি বা সুবিধা গ্রহণের পথও তৈরি হবে।

বাংলাদেশে আগে থেকে চাষ হতো না বলে এ ফুল সম্পর্কে খুব একটা পরিচিত নই। বাংলাদেশের জনশক্তিকে ল্যাভেন্ডার সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করা গেলে সর্বত্র চাষ করে পর্যটন ও শিল্প কেন্দ্রিক বৃহৎ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা যাবে। যুক্তরাজ্যে অনেক ল্যাভেন্ডার বাগান বা খামার আছে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ল্যাভেন্ডার বাগান থেকে ঘুরে আসা বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে ল্যাভেন্ডারের গন্ধই ল্যাভেন্ডার প্রেমিকদের বাগানের সন্ধান দিয়ে দেয়। বাগানগুলোতে দর্শকদের ভিড় সব সময় লেগেই থাকে।

আরও পড়ুন
তরুণদের আশার আলো হাইলাইন ব্রাউন জাতের মুরগি
টাঙ্গাইলে ৫৮ কোটি টাকার হলুদ বিক্রির সম্ভাবনা

মূলত গ্রীষ্মকালেই ল্যাভেন্ডার চাষ করা হয়। ইংল্যান্ডের ল্যাভেন্ডার বাগানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে। যেমন- ক্যাফে থেকে শুরু করে গিফট শপ, কার পার্কিং ও টয়লেট। এমনকি পুরো বাগান ঘুরে দেখার জন্য ট্র্যাক্টর ভাড়া নেওয়া যায়। এ ক্যাফেতে কফির পাশাপাশি ল্যাভেন্ডের চা-ও পাওয়া যায়। বাগানের পাশে বিভিন্ন দোকান থাকে। সেখানে বিক্রি করা হয় ল্যাভেন্ডার দিয়ে তৈরি দ্রব্যসামগ্রী ও খাদ্যসামগ্রী। এমনকি এসব খামারে ল্যাভেন্ডারের গাছ ও চারা বিক্রি করা হয়। তবে খুব একটা বেশি দাম নয়। গাছগুলোর মূল্য তিন পাউন্ড থেকে শুরু করে দশ পাউন্ডের মধ্যে।

সুগন্ধিই ল্যাভেন্ডারের পুঁজি
ল্যাভেন্ডার ফুলের নির্যাসের ঘ্রাণে দিনভর ফুরফুরে মেজাজে থাকতে পছন্দ করতো প্রাচীনকালের অভিজাত ও সৌখিন ফরাসিরা। স্পেনের যেসব এলাকায় বড় বড় ল্যাভেন্ডার বাগান আছে, সে এলাকার আকাশ-বাতাস গন্ধে ভরে ওঠে। সুগন্ধিপ্রেমীদের কাছে ল্যাভেন্ডার খুবই প্রিয়। ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূলে ‘ফুলের রাজধানী’ গ্রাস শহর। আলপ্সের কোলে মহিমাময় নির্জন পাহাড়ঘেরা ছবির চেয়ে সুন্দর এ শহরের আরেক নাম ‘সুগন্ধি শহর’। ফ্রান্সের বিখ্যাত পারফিউম তৈরির কারখানাগুলো এখানেই। শহরে ছোট-বড় বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে চমৎকার বেগুনি রঙের ফুলটি ঘিরে।

সুগন্ধি সাবান, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে হাজারো রকমের প্রসাধনী ও সুগন্ধি তৈরিতে ল্যাভেন্ডারের ব্যবহার ব্যাপক। নারীর জন্য পারফিউম তৈরিতেও এ নির্যাসের ব্যবহার করা হয়। শ্যানেলের অনেক প্রসাধনী ও পারফিউমে ল্যাভেন্ডারের নির্যাস স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। ল্যাভেন্ডারকে বাদ দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে বহু পারফিউম ও প্রসাধনী তৈরির কথা ভাবা যায় না। অনেকটা কিংবদন্তির পরি-কন্যা লাভ্যানডিনের মতো ল্যাভেন্ডার প্রসাধনী ও সুগন্ধির বিশাল জগতে সত্যিকারের কিংবদন্তি। অনেকটাই তুলনাহীন এক অলৌকিক সৃষ্টি, যেন স্বর্গ থেকে বিচ্যুত বেগুনি অশ্রুজলের ফুল।

প্রাচীনকাল থেকে রোমান ও গ্রিকরা ল্যাভেন্ডারের ওষুধি গুণের কথা জানতো। রোমান রাজাদের স্নানে ল্যাভেন্ডারের নির্যাস ছিল প্রতিদিনের সঙ্গী। তা ছাড়া দামি কাপড় পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ল্যাভেন্ডার সেই প্রাচীনকাল থেকেই সমান জনপ্রিয়। ছত্রাক সংক্রমণ, প্রদাহ নিরাময়ে, ক্ষতস্থান দ্রুত সারাতে এবং পেশীর ব্যথা উপশমে, চুলের উজ্জ্বলতা বাড়াতে, ত্বকের যত্নে ল্যাভেন্ডারের নির্যাস, উদ্বায়ী তেলযুক্ত বহু ক্রিম ও লোশন বাজারে পাওয়া যায়।

এককথায় বাংলাদেশে ল্যাভেন্ডারের চাষ বেগবান হলে এখানে গবেষণাগার, শিল্প-কারখানা, হোটেল, মোটেল, রিসোর্টসহ সম্ভাবনাময় অবকাশ কেন্দ্রের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। সুতরাং যেসব দেশে এখন ল্যাভেন্ডারের চাষ হয়; সেখানে এটি অর্থকরী ফসল হিসেবে মানুষকে সুবিধা দেওয়ার চেয়েও পর্যটন বিকাশে টানছে বেশি।

লেখক: পর্যটন বিশ্লেষক।

এসইউ/এএসএম

Read Entire Article