বাউল শাহ আবদুল করিমের স্মৃতি

7 hours ago 4

বাউল শাহ আবদুল করিমের প্রয়াণ দিবস ছিল গতকাল ১২ সেপ্টেম্বর। এ উপলক্ষে বাউলের সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতি স্মরণ করে লিখেছেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান

২০০৫ সালের কথা। বিসিএস-তথ্য সার্ভিসে প্রবেশের মাস পেরোয়নি। এরই মধ্যে ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ে যেতে হয়েছিল। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে মাঠপর্যায়ে, সিলেট অঞ্চলে লোক-ঐতিহ্য সংগ্রহের কাজ। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের বাড়ি ছিল আমাদের গন্তব্য। তখনও এত মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেননি এই সাধক।

ঢাকা থেকে সিলেট, ভ্রমণ-ক্লান্তি না কাটতেই রওয়া দিই সুনামগঞ্জ। বিরতি না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্থানীয় শিল্পী বান্না সাহেব। আমাদের দলে ৬ জন, সুনামগঞ্জ পৌঁছালাম রাত সাড়ে ১২টায়। সার্কিট হাউসে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে রওনা দিলাম দিরাই বাজার। প্রচণ্ড বৃষ্টি। কাঁদা-পানিতে বাজারের প্রায় সব ডুবে গেছে। আমাদের দলে মঈন স্যার, ব্যাচমেট আহসান হাবিব, রফিকুল, শামীম ও নিমকোর মারুফ নেওয়াজ। শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে যাওয়ার লাইনে চলাচলকারী কোন ট্রলার পাওয়া যাচ্ছিলো না।

ঘাটে বাঁধা অব্যবহৃত একটি ট্রলার ভাড়া করলাম আমরা। পথে বৃষ্টি বাড়লো। পানির ওঠানামা বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিলো। হাওরের মাঝামাঝি পৌঁছতেই হঠাৎ শব্দে ভেঙে গেল একটি বেঞ্চ। আমাদের ভয়-চিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিল হাওরের বুক। ট্রলার ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল, কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন। ট্রলার ডোবেনি, ভাঙেনি, ফুটোও হয়নি! এমন ভয়ানক পরিস্থিতির কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম বাউলের বাড়িতে।

সুনসান নিরব বাড়িটা। ডাকাডাকির একপর্যায়ে বেরিয়ে এলেন শাহ আবদুল করিমের ছেলে শাহ নূর জালাল। পরিচয় ও উদ্দেশ্যের কথা জেনে বসতে দিলেন বাংলা ঘরে। ভেতরে ঢুকেই ভক্তদের উদ্দেশে ব্যানারে একটি লেখা চোখে পড়লো। তাতে লেখা ছিল ‘শাহ মো. আবদুল করিম সাহেবের বাড়িতে।’ আমরা অপেক্ষা করছিলাম। এরই মধ্যে কয়েকবার ছেলে এসে জানালেন তার বাবা অসুস্থ, বিছানা থেকে উঠে আসার মতো শক্তি নেই। যদিও আমরাও আগে থেকে যোগাযোগ করে যাইনি। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর ছেলের হাত ধরে ধীর লয়ে হেঁটে হেঁটে বাউল করিম আমাদের সামনে এলেন।

বিনয়ী ভঙ্গিতে আমাদের সালাম বিনিময় হলো। ততক্ষণে আমরাও রেডি হয়ে গেলাম সাক্ষাৎকার আর খালি গলায় গান রেকর্ড করার জন্যে। ছেলে জালাল ঘরের ট্রাঙ্ক থেকে বাবার পুরনো গানের বইটা নিয়ে এলেন। বাবার কানের কাছে জোরে জোরে তার জনপ্রিয় গানগুলোর মূল সুর মনে করিয়ে দিতে লাগলেন। তিনি শুধু গানের মুখটা গেয়ে শোনালেন। এতেই তার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। কোনোভাবেই পারছিলেন না। বার বার ভুলে যাচ্ছিলেন। কথায় কথায় বলতেন, ‘চশমা কই?’ আমরাও ধৈর্য ধরে একটু একটু করে তার কণ্ঠে কালজয়ী গান ‘গাড়ি চলে না’, ‘বন্দে মায়া লাগাইছ ‘, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে’, ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাওগো’ রেকর্ড করলাম।

কয়েকটি গান বইতে পেয়ে বিস্মিত হয়েছি। এর আগে অন্য শিল্পীদের কণ্ঠে এই গানগুলোকে ‘সংগ্রহ’ বলে গাইতে শুনেছি। শিল্পীর সাক্ষাৎকারে অনেক কথার কিছু কথা মনে পড়ে আজও। বলেছিলেন, তার গানগুলো বিকৃত সুরে গাইলে খুব রাগ লাগে। কেউ যেন তার গান বেসুরে না গায়, গানের কথা যেন পরিবর্তন না করে এবং তার লেখা গানে যেন অন্যের নাম ব্যবহার করে প্রচার না করে। আমাদের কাছে পেয়ে ছেলে তার বাবার গানের রয়্যালটি এবং গান যে চুরি হচ্ছে, তা বন্ধ করার অনুরোধ জানালেন।

এভাবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো। ফেরার সময় কথায় কথায় ‘চশমা খোঁজার’ বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল হলো। ছেলে জানালেন, তার বাবার চশমা ভেঙে গেছে। অর্থের অভাবে সেটা আর কেনা হয়নি। ব্যাপারটা সবার মনে দাগ কাটলো। সহকর্মীরা মিলে চশমা কেনার জন্য বাউল সম্রাটের হাতে ৩৫০ টাকা তুলে দিলাম। যদিও পরিমাণ খুবই নগন্য। এরচেয়ে বেশি দেওয়ার উপায়ও ছিল না তখন। টাকাটা পেয়ে তিনি যে কি খুশি হয়েছিলেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। আমাদেরও চোখের কোণে অশ্রু ছলছল করছিল। ওই ক্ষণটির কথা কখনও ভুলবো না।

ফেরার আনুষ্ঠানিকতা চলছিল। বাউল শাহ আবদুল করিম কিছুতেই আমাদের আসতে দেবেন না। আবদার করলেন, থাকতেই হবে। বারবার বলতে লাগলেন, আমাদের জন্য যে কিছুই করতে পারলেন না। আমরাও বুঝিয়ে-শুনিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে ট্রলারের কাছাকাছি গেলাম। তাতে মন মানলো না দরদী করিমের। ছেলের হাত ধরে আমাদের সাথে ট্রলারের কাছে এলেন। ঘাড়ে গামছা ঝুলিয়ে দুহাতে লুঙ্গি উচিয়ে হাঁটু পানিতে নেমে দাঁড়ালেন। অশ্রুজলে আমাদের বিদায় দিলেন। আমরা ফিরে এলাম। ট্রলার যতক্ষণ দৃষ্টির মধ্যে ছিল, ততক্ষণ তিনিও পানিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলেন। আমরাও মায়াবী চোখে দূরে যেতে যেতে দেখছিলাম ভাটির মায়াবী পুরুষকে। বুকে চাপা কষ্ট অনুভূত হচ্ছিল বারবার। মনে হচ্ছিল, কী যেন ফেলে এসেছি। বিদায় বেলার এ দৃশ্যটিও মন থেকে মুছবে না কোনদিন।

ভাটি অঞ্চলের এক খাঁটি শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন আবদুল করিম। তার গানের কথা ও সুর এত মধুর যে, আমাদের মন আর কানকে আঁকড়ে ধরে। আমাদের মনের গভীরে থাকা শহর আর গ্রামে তার গান এক অমূল্য সম্পদ। গানমাখা তার ব্যক্তিজীবনের কথা জেনে শিহরিত হতে হয়।

গতকাল ১২ সেপ্টেম্বর ছিল প্রবাদপ্রতিম বাউল শাহ আবদুল করিমের প্রয়াণের দিন। বাউল গানের অমর শিল্পী শাহ আবদুল করিম আজ আমাদের মাঝে নেই ঠিকই। কিন্তু অগণিত ভক্তর স্মৃতিতে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। গুণী এ সাধকের মৃত্যুদিনে তার আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

এমএমএফ/আরএমডি

Read Entire Article